আবদুল্লাহ আল মামুন:
বাংলাদেশে প্রায় এক হাজার ২০০টি আইন প্রচলিত আছে। জীবন ও জীবিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এমন কোনো আইন নেই যা বর্তমানে প্রচলিত নেই। এ ছাড়া নিত্যনতুন আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে। কিন্তু বর্তমান সমাজব্যবস্থার দিকে দৃষ্টিপাত করলে হতাশ হতে হয়। আইনের সঠিক প্রয়োগ না হওয়ায় অপরাধ এবং সমাজে অপরাধী ও আইন ভঙ্গকারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
প্রচলিত আইনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ও সমালোচিত আইন হচ্ছে ‘মোবাইল কোর্ট আইন-২০০৯’। আইনটির প্রকাশভঙ্গি ও প্রয়োগ ত্রুটিজনিত কারণে এ বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও অপরাধ প্রতিরোধ কার্যক্রমকে কার্যকর ও অধিকতর দক্ষতার সঙ্গে সম্পাদন ও প্রয়োগ করার উদ্দেশ্য নিয়ে এই আইন প্রণীত হয়েছে। আইনটির ৫ ধারা অনুসারে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং অপরাপর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্তি সাপেক্ষে প্রয়োগযোগ্য। আইনটির সদিচ্ছা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই, কিন্তু প্রয়োগের ক্ষেত্রে সতর্কতার প্রয়োজন রয়েছে।
চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বাধীন জুডিশিয়াল বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটদের আদালতের বিচার কার্যক্রম ফৌজদারি কার্যবিধিতে বর্ণিত পদ্ধতি সম্পূর্ণভাবে অনুসরণ করা হয়। আদালতগুলোতে সংক্ষিপ্ত ও দীর্ঘ পদ্ধতিতে বিচার নিষ্পন্ন করা হয়। আইনই নির্ধারণ করে বিচার পদ্ধতি। কিন্তু উভয় পদ্ধতিতেই অভিযোগ গঠন করে সাক্ষ্য গ্রহণ করে রায় প্রদানের মাধ্যমে বিচার নিষ্পত্তি করা হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনটি মৌলিক কিছু বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। আইনটিতে বর্ণিত নিষ্পত্তি পদ্ধতি ফৌজদারি কার্যবিধিতে বর্ণিত পদ্ধতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। আইনটির মূল বিষয় হলো তফসিলে বর্ণিত অপরাধটি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ‘সম্মুখে সংঘটিত বা উদ্ঘাটিত’ হতে হবে [ধারা-৬(১)]। এ ক্ষেত্রে সংঘটিত শব্দটি নির্দেশ করে ‘অপরাধ সম্পাদনকে’ এবং উদ্ঘাটিত শব্দটি নির্দেশ করে ‘উদ্ভাসিত’ হওয়াকে। উভয় শব্দকে ‘সম্মুখে’ শব্দটি দ্বারা সনি্নবেশিত করা হয়েছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকালে যদি তার সামনেই তফসিলোক্ত কোনো অপরাধ ঘটে তবেই তার এখতিয়ারের উদ্ভব ঘটে। যেমন ভ্রাম্যমাণ আদালতের সম্মুখেই যদি কোনো ব্যক্তি মাদক পরিবহনের সময় আটক হন, তবে তফসিল সাপেক্ষে তিনি তা আমলে নিতে পারবেন। অন্যদিকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকালেই তাঁর সামনে যদি বিক্রয়ের জন্য রাখা মাছ ফরমালিনযুক্ত হওয়ার বিষয় প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে ‘উদ্ঘাটিত’ হয় তবে তিনি তা আমলে নিতে এবং আইন অনুযায়ী অগ্রসর হতে পারবেন। অন্যথায় পারবেন না। অনেক সময় দেখা যায়, ভ্রাম্যমাণ আদালতের সামনে অপরাধ সংঘটিত হয়নি। পুলিশ অভিযুক্তকে আটক করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে নিয়ে যায়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর অফিসে আদালত বসিয়ে সাজা প্রদান করেন। ধারা ৬(১)-এর ব্যাখ্যার আলোকে বিষয়টি নিঃসন্দেহে আইনবহির্ভূত।
আইনটির অন্য একটি মৌলিক বিষয় হলো আসামির দোষ স্বীকারোক্তি। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অপরাধ আমলে নেওয়ার পর সংশ্লিষ্ট আইনে অভিযোগ গঠন করে উপস্থিত আসামিকে শুনিয়ে ও ব্যাখ্যা করে আসামি দোষ স্বীকার করে কি না জানতে চাইবেন। আসামি যদি দোষ স্বীকার করে তবে স্বীকারোক্তি যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করে তাতে আসামির স্বাক্ষর বা টিপসই এবং উপস্থিত দুজন সাক্ষীর স্বাক্ষর বা টিপসই গ্রহণ করবেন (ধারা-৭)। অতঃপর দণ্ড আরোপ করবেন। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে অবশ্যই আসামির স্বেচ্ছাকৃত অপরাধ ও স্বীকারোক্তি সম্পর্কে বক্তব্য অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পর্যালোচনা করতে হবে। কারণ পরিস্থিতি-পারিপার্শি্বকতা বিবেচনায় আসামির দোষ স্বীকারোক্তি স্বেচ্ছায় নাও হতে পারে। দোষ স্বীকারোক্তি যদি স্বেচ্ছায় না হয়ে ভয়ভীতি, মারধর, হুমকি, প্রলোভন প্রভৃতির কারণে হয় তবে সাজা প্রদান আইনের দৃষ্টিতে অবৈধ। যদি আসামির বা সাক্ষী দুজনের স্বাক্ষর বা টিপসই ঘটনাস্থলে না নেওয়া হয় তবে পুরো প্রক্রিয়াটিই প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য। অন্য একটি বিষয় হলো, আসামি যদি দোষ স্বীকার না করে তবে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর ব্যাখ্যা জানতে চাইবেন। ব্যাখ্যা সন্তোষজনক হলে অব্যাহতি দিতে পারবেন। ব্যাখ্যা সন্তোষজনক না হলে উপযুক্ত আদালত বরাবর (জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট) অভিযোগটি পাঠাতে হবে। এ ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেট ইতিমধ্যেই অপরাধ আমলে নিয়েছেন এবং অভিযোগ গঠন করেছেন বলে থানায় পাঠানোর কথা আইনে বলা হয়নি। ধারা-৭-এর দুর্বলতা হলো, আসামি দোষ স্বীকার না করলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সাক্ষ্য গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। সাক্ষ্য গ্রহণ করার ক্ষমতা না থাকায় পুরো বিষয়টিই এ ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। তাই বলা যায়, যদি আসামি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে অপরাধ স্বীকার না করে তবে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কোনোক্রমেই আসামিকে সাজা দিতে পারেন না।
এখতিয়ার অতিক্রম করা একটি আধাবিচারিক পদ্ধতিকেও প্রশ্নের সম্মুখীন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একজন ব্যক্তি ৩০০ গ্রাম হেরোইন বহন করার সময় হাতেনাতে আটক হলো। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাজা দিলেন। এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সাজা এবং পদ্ধতিই এখতিয়ারবহির্ভূত। কারণ হেরোইনের পরিমাণ অনুযায়ী এ ক্ষেত্রে বিষয়টি বিচার করবেন বিজ্ঞ সেশনস বা দায়রা জজ। এ ক্ষেত্রে অভিযুক্তের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, এমনকি মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে। তাই অভিযোগটি নিয়মিত মামলা হিসেবে রুজু করার জন্য থানায় পাঠানোই ৬(৪) ও ৬(৫) ধারানুসারে শ্রেয়। প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক বিচার্য সব অপরাধের বিচারের প্রাথমিক এখতিয়ার হলো প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে ক্ষমতা প্রদান ব্যতিক্রম মাত্র (ধারা-৪) (‘সীমিত ক্ষমতা’)। যা জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক বিচার্য নয় তা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বিবেচনারও এখতিয়ার রাখেন না। হেরোইনের মামলার বিচার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট করতে পারেন না বলে এ ক্ষেত্রে এখতিয়ার প্রয়োগ সম্পূর্ণ আইনবহির্ভূত [ধারা-৬(৩)]।
এ আইনের অন্য একটি মৌলিক বিধান হলো আপিল সংক্রান্ত বিধান (ধারা-১৩)। এ আইনে আপিল শ্রবণের প্রাথমিক এখতিয়ার অর্পণ করা হয়েছে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। অতঃপর পুনরায় ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে বিজ্ঞ দায়রা জজের কাছে। এ ক্ষেত্রে বিষয়টি বোঝার অবকাশ রয়েছে। মনে হতে পারে, এ আইনে দুবার আপিল করার এখতিয়ার প্রদান করা হয়েছে, যা বহু আগেই আমাদের ফৌজদারি কার্যবিধি থেকে বাতিল করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে জুনিয়র নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাজা দিলে তার বিরুদ্ধে আপিল দায়ের করতে হবে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে, যা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠাতে পারেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বিজ্ঞ দায়রা জজের কাছে রিভিশন দায়ের করতে পারেন। আবার স্বয়ং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে সাজা দিলে তার আপিল শুনবেন বিজ্ঞ দায়রা জজ বা অতিরিক্ত দায়রা জজ।
সাজা দেওয়ার ক্ষেত্রে যদি ধারা-৭ অনুসরণ করা না হয় তবে পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে ন্যায়বিচার ব্যাহত এবং ‘রুল অব ল’ অনুসরণ না করায় ওই সাজা প্রদান সংক্রান্ত আটকাদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট দায়ের করতে পারেন।
আইনের প্রয়োগ করার সময় আইনের স্বতঃসিদ্ধ নীতিগুলোকে অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে। অবশ্যই আইনটি প্রণয়নের লক্ষ্যকে অনুধাবন করতে হবে। তফসিলে সংযুক্ত বেশির ভাগ আইন পেটি (petty) প্রকৃতির। ক্ষুদ্র প্রকৃতির বিষয়গুলোর মামলার কারণে যাতে আদালতগুলো অযথা ভারযুক্ত হয়ে না পড়ে এবং তফসিলোক্ত বিষয়গুলোর দ্রুত অথচ কার্যকর নিষ্পত্তির লক্ষ্যেই সরকার এ আইন প্রণয়ন করেছে। আইনটির যথাযথ প্রয়োগ নিত্যনৈমিত্তিক জনজীবনে স্বস্তি ও আস্থার সৃষ্টি করতে পারে। অপরাধী যেমন চালক, ভেজাল বা ওজনে কম দেওয়া পণ্য বিক্রেতা, পাবলিক পরীক্ষায় নকলকারী, ভুয়া ডাক্তার, জাটকা মাছ আহরণকারী, অবৈধ ইটখোলা পরিচালনাকারী, নির্দিষ্ট পরিমাণ পর্যন্ত মদ, গাঁজা বহনকারী, বিক্রয়কারী বা সেবনকারী, অবৈধভাবে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রয়ের ব্যবসায়ী, অসাধু ব্যবসায়ী, জনগণের জন্য নির্ধারিত স্থানে অবৈধ ধূমপায়ী, জুয়াড়িকে এ আইনের মাধ্যমে দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব; যা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে যেমন উদাহরণের সৃষ্টি করবে তেমনি সম্ভাব্য অপরাধীদের প্রতিহতও করবে। একটি সুস্থ, সুন্দর, আস্থার, বিশ্বাসের, শান্তির সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণে এ আইনের আইনানুগ প্রয়োগ যথাযথ এবং ফলপ্রসূ হবে বলে সবাই আশা করতে পারে।
লেখক : সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, বর্তমানে গবেষণা কর্মকর্তা, বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, ঢাকা
Discussion about this post