ড. বদরুল হাসান কচি
‘আজকাল হরতাল, অবরোধ মোটরসাইকেল চালকের সঙ্গে অন্য আরোহী চড়ে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে। ফলে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। এসব নাশকতারোধে মোটরযান অধ্যাদেশ, ১৯৮৩ এর ধারা ৮৮ মতে, মোটর সাইকেলের সঙ্গে অন্য আরোহী চড়তে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। যা পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।’- গেলো জাতীয় নির্বাচন পরবর্তী সময়ে একটি প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলের ডাকা অবরোধ কর্মসূচি পালনকালীন সময়ে এমন একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিলেন সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআরটিএ। ঐ সময়েটাতে আমরা কি দেখলাম, মোটর সাইকেল চালকের পেছনের আরোহীর ছোড়া পেট্রোল বোমায় শত নিরপরাধ জনগণের প্রাণ গেলো এবং কোটি কোটি টাকার সম্পদ ছাই হলো আগুনে। কেউ কি তখন ধরা পড়লেন? না, বোমা মেরে সেই মোটরসাইকেলে মুহূর্তেই উদাও। সেই সময়ের পরিস্থিতি পাঠকের অজানা নয়; তাই এই বিষয়ে আর গভীরে যাবো না।
বিআরটিএ এর জারিকৃত এই ঘোষণাটি তখন জনগণ আতংকে হোক, নিরাপত্তার খাতিরে হোক কিংবা প্রশাসনের চেষ্টায় হোক আইনটি তখন মানতে দেখা গেছে। ফলে অপরাধের মাত্রা স্বাভাবিকভাবে কমে গেলো। এই উদাহরণের মাধ্যমে আমাদের কাছে আরো একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে তাহলো জনগণ নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে আইন মানে, আবার কেউ আইন মানতে না চাইলে প্রশাসনের স্বদিচ্ছা থাকলে আইন মানাতে বাধ্য করানো যায় অর্থাৎ অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আলোচনার সুবিধার্থে ঘটনাটিকে টেনে আনলাম এই কারণেই যে, মোটর সাইকেলে অপরাধের সহজতা এবং মাত্রা বোঝাতে। কতো সহজে মোটর সাইকেল আরোহী অপরাধ করতে পারে এবং অপরাধ করে নিরাপদে পালিয়ে যেতে পারে। এছাড়া অপরাধের মাত্রাটিও আমাদের কাছে স্পষ্ট আবার অজানা কোন কারণে কারো কাছে অস্পষ্টও বটে।
বিআরটিএ’র তথ্যমতে, রাজধানীতে নিবন্ধিত মোটর সাইকেলের সংখ্যা ছয় লক্ষাধিক। এছাড়াও খোদ রাজধানীতেই নিবন্ধন ছাড়া প্রায় পাঁচ লাখ মোটর সাইকেল রয়েছে, আর সারাদেশের পরিসংখ্যানতো ভয়াবহ। ভারত থেকে ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে মোটরসাইকেলগুলো দেশে ঢুকছে। যেখানে অবৈধ মোটরসাইকেলের সংখ্যা পাঁচ লাখ সেখানে প্রতিদিন কয়েকশ অপরাধ সংগঠিত হওয়া স্বাভাবিক বিষয় এবং হচ্ছেও তাই। রাজধানীতে সন্ধ্যা নামলেই উৎসব শুরু হয়ে যায় মোটর সাইকেল আরোহী ছিনতাইকারীদের। পুরো রাজধানিজুড়ে প্রতিটি এলাকায় ছিনতাইকারীদের উপদ্রপ রয়েছে। বিশেষকরে ভুক্তভোগী হচ্ছেন নারীরা। রিকশায় বসে তারা নিজেদের ব্যানিটি ব্যাগটি না পারেন কাঁদে ঝুলিয়ে রাখতে না পারেন নিজের হাতে রাখতে। সবাই প্রতি মুহূর্তে আতংকে থাকেন কখন নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস মোবাইল টাকাসহ নিজের ব্যাগটি মোটর সাইকেল আরোহী কোন ছিনতাইকারী নিয়ে যায়। চিল যেমন ছোঁ মেরে খাবার নিয়ে যায় অনেকটা সেই রকম। এইসব ছিনতাইকারী কখনো একক নয়। মোটরসাইকেল চালকের পেছনেও এক দুইজন থাকেন। কখনো কখনো এরা সংঘবদ্ধ থাকেন, দুই তিন মোটর সাইকেল এক সাথে অভিযানে নামেন। যাতে কেউ বিপদে পড়লে অন্যরা এগিয়ে আসতে পারেন। তেমন একটি অভিযানের মুখোমুখি চলতি বছরেই আমি নিজে হয়েছিলাম। ভুক্তভোগীরা এক্ষেত্রে শুধু প্রয়োজনীয় জিনিস হারাচ্ছেন তা নয় শারীরিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এমন ঘটনাগুলো রাজধানীতে প্রত্যহ শতশত ঘটছে। কিন্তু দেশের বড় বড় ঘটনাগুলোর বিড়ে ছোট ছোট এইসব ঘটনা মিডিয়ায় জায়গা পায় না। তাই আলোচনাও নেই। আর কোন বিষয় আলোচনায় না থাকলে আমাদের পুলিশ প্রশাসন এসব গায়ে লাগান না। জনগণের যায় যাক তাতে আমার কি- এমন ভাবসাব। অনেকের ধারণা এই চক্রের সাথে থানা পুলিশের যোগ-সাজেশ রয়েছে। তানাহলে কেউ কোন কারণে জনতার হাতে ধরা পড়লেও সে থানা থেকেই নিস্তার পেয়ে যায়। আবার দেখা গেছে রাতে যে ছেলেটি ছিনতাই করছে সেই ছেলে দিনের বেলা এলাকা ভিত্তিক কোন রাজনৈতিক দলের নেতাকে একই মোটরসাইকেলে প্রটোকল দেন। সে সূত্রেই তার মোটরসাইকেল এবং অন্ধকারের কর্মকাণ্ড দুইটার বৈধতা পেয়ে যান। তাই অনেক সময় পুলিশের স্বদিচ্ছা থাকলেও এদের বিরুদ্ধে তেমন কোন পদক্ষেপ নিতে পারেন না। কোথাও যেন হাত পা বাঁধা অবস্থা। এছাড়া শুধু যে ছিনতাই ঘটছে তা নয়, রাজধানীতে এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় মাদকের অবাধ আদান প্রদান হয় এই মোটর সাইকেল আরোহীদের মাধ্যমে।
সম্প্রতি দেশে মোটরসাইকেল আরোহীদের পরপর দুইটি ঘটনা মিডিয়া এড়িয়ে যেতে পারেননি, তেমনি এড়াতে পারেননি দেশের প্রশাসন। ঘটনাটি ছোট কি বড় সেটা মুখ্য নয়, মুখ্য কারণ এবার ভুক্তভোগীরা এই দেশের নাগরিক নয়, তারা ভিনদেশি। একজন ইতালিয়ান, আর একজন জাপানিজ। একজন রাজধানীর সবচেয়ে সুরক্ষিত জায়গা গুলশানে এবং অন্যজন রাজধানীর বাহিরে একটি গ্রামে দিনের আলোতে বুলেটের আঘাতে খুন হন। দুইটি ঘটনার স্থান ভিন্ন হলেও মিল রয়েছে বেশ। যেমন একটি মোটরসাইকেলে চালকসহ ছিলেন আরো দুইজন আরোহী এবং গুলি করে মোটরসাইকেলে দ্রুত পালিয়ে যায়। এই দুইটি ঘটনায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে আজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। কূটনৈতিক পাড়ায় আজ রেড এল্যাট জারি হয়েছে। জাপানের উন্নয়ন সংস্থা জাইকার ৬৮ কর্মকর্তা কাজ করছে দেশের বিভিন্ন জেলায়, তাদের ছুটি ঘোষণা করেছে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত। তৈরি পোশাক খাতের বিদেশী ক্রেতারা এদেশে গার্মেন্টস মালিকদের সাথে নির্ধারিত বৈঠক বাতিল করেছেন। এক কথায় দেশের অর্থনীতিতে খানিকটা ধাক্কা লেগেছে।
তাই বলছি দেশের সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে মোটরসাইকেল চালকের সাথে আর কোন আরোহী যাতে না চড়ে সেই নিষেধাজ্ঞা জারি করা এবং ঘোষণাটি অর্থাৎ আইনটি যাতে কার্যকর থাকে সেই ব্যাপারে প্রশাসন যাতে তৎপর থাকে তা জরুরী প্রয়োজন।
লেখক: আইনজীবী,
Discussion about this post