ছেলে ও মেয়ে শিশুর অধিকার
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিকঃ
আইন আদালত-আমাদের দেশে শিশুর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। বাড়ি, অফিস, কল-কারখানাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিষ্ঠুর আচরণের শিকার হচ্ছে কোনো না কোনো শিশু। এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও শিশুর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করছে, যা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। এক শ্রেণীর মাদক ব্যবসায়ী মাদক বিক্রি বা মাদক পাচারে শিশুদের কাজে লাগাচ্ছে। গাঁজা বহন করার সময় কিংবা অস্ত্র বহন করার সময় পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে কোনো শিশু- খবরের কাগজে প্রতিনিয়ত এরকম খবর প্রকাশ পাচ্ছে। শুধু মাদক কিংবা অস্ত্র পাচার নয়, বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে শিশুদের নিয়োগ করছে প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলো। শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োগ করা হচ্ছে। বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে শিশুদের অপরাধপ্রবণ হতে বাধ্য করা হচ্ছে। এসব কাজ আইনের চোখে শিশুদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ হিসেবে গণ্য হওয়া সত্বেও তা থেমে নেই।
আইন আদালত এর ৩৮০ ধারায় চুরির মামলা
শিশু আইনের বিভিন্ন ধারা
-
হাইকোর্ট বিভাগ,
-
দায়রা আদালত,
-
অতিরিক্ত দায়রা জজ ও সহকারী দায়রা জজ আদালত,
-
মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট,
-
প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট। এখন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটরা বিচার করেন।
-
আইন আদালত অনুসারে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ হিসেবে বিবেচিত হবে।
-
শিশুর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সম্পর্কে তাকে মা-বাবা বা অভিভাবকের মাধ্যমে জানাতে হবে এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য আইনগত ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে হবে।
-
শিশুকে আদালতে প্রমাণাদি পেশ করার বা অপরাধ স্বীকারে বাধ্য করা যাবে না।
-
কোনো শিশু ফৌজদারি আইন লঙ্ঘন করেছে বলে বিবেচিত হলে সে সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত বা ব্যবস্থার বিষয়ে উচ্চতর উপযুক্ত, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কর্তৃপক্ষ বা আদালতের আইনানুসারে পুনর্বিবেচনা করতে হবে।
-
বিচারপ্রক্রিয়ার সর্বস্তরে শিশুর গোপনীয়তার প্রতি পূর্ণ সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। জুভেনাইল কোর্টের অধীনে অভিযুক্ত শিশুদের বিচার ও তাদের কারাগারে না পাঠিয়ে সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানোর কথা থাকলেও প্রায় সব ক্ষেত্রেই সাধারণ আসামি ও কয়েদিদের মতোই তাদের বিচার ও সাজার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কোনো থানায় শিশু-কিশোরদের আটক করা হলে তাদেরও সাধারণ বন্দিদের সঙ্গেই চালান করে দেয়া হয়। টঙ্গীতে অবস্থিত কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে জুভেনাইল কোর্ট থাকলেও থানা থেকে সাধারণত কোনো শিশু-কিশোরকে সেখানে পাঠানো হয় না। কারাগারে আটক শিশুরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগও পায় না। আর এমন নিপীড়নমূলক অবস্থায় শিশুরা থাকে যা তাদের সংশোধিত হওয়ার বদলে ধীরে ধীরে একজন প্রকৃত অপরাধী হয়ে উঠতে সাহায্য করে।
আমাদের দেশের রাষ্ট্রীয় আইনের বিধান অনুযায়ী অভিযুক্ত শিশু-কিশোরদের সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানোর কথা। কিন্তু বাংলাদেশে এ ধরনের সক্রিয় সংশোধন কেন্দ্র আছে ঢাকার টঙ্গীতে। ঢাকার টঙ্গীতে যে কিশোর সংশোধনাগার রয়েছে তার মান নিয়ে বহু প্রশ্ন রয়েছে। সংশোধনাগারটিও যে উদ্দেশ্য সাধনে পুরোপুরি তা সফল হচ্ছে না। রাস্তাঘাট বা বিভিন্ন স্থান থেকে আটক করে পুলিশ পেশাদার পতিতা, ছিন্নমূল মানুষ তাদের সঙ্গে অনেক শিশুকেও ভবঘুরে আশ্রয় কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়। কে›ন্দ্রগুলোতে আটককৃতদের ভালো আশ্রয়, খাদ্যসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা এবং কাজ শেখানোর কথা থাকলেও বাস্তবতা মোটেই সুখকর নয়। কাজেই এমনটি করা উচিৎ যাতে কারাগারের চার দেয়ালের মধ্যে শিশুবান্ধব পৃথিবী সৃষ্টি করা সম্ভব হয় অন্যথায় ‘নিরাপত্তা হেফাজতে’ নির্যাতনের তালিকা দিন-দিন লম্বা হতে থাকবে ও এর প্রচলন এক ধরনের আইনগত বৈধতা পেয়ে যাবে।
শিশুর প্রতি নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে আইন আদালত
এবার দেখা যাক শিশু আইন, ১৯৭৪-এ শিশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা বা শিশুদের অপরাধ করতে বা অনৈতিক কাজে ব্যবহার করার শাস্তি কি রয়েছে। এ আইনে ৩৪, ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০, ৪১, ৪২, ৪৩, ৪৪, ৪৫, ধারায় শিশু সস্পর্কিত বিশেষ অপরাধ ও শাস্তির বর্ণনা করা হয়েছে।
১. শিশুর প্রতি নিষ্ঠুরতার দন্ড
১৯৭৪ সালের শিশু আইন অনুযায়ী ১৬ বছরের কম বয়স্ক ব্যক্তি শিশু। ১৬ বছরের বেশী বয়স্ক ব্যক্তি যদি কোনো শিশুকে আক্রমন, উৎপীড়ন, অবহেলা, বর্জন অথবা অরক্ষিত অবস্থায় পরিত্যাগ করে অথবা করায় এবং এ ধরনের কাজের ফলে শিশুটির অহেতুক দুর্ভোগ হয়, তাহলে এটা হবে শিশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা। দুর্ভোগের কারণে যদি শিশুর স্বাস্থ্যের প্রতি ক্ষতি হয়, তার দৃষ্টি বা শ্রবণশক্তি নষ্ট হয় বা মানসিক বিকৃতি ঘটে তাহলে নিষ্ঠুর আচরণকারী ব্যক্তি শিশু আইনের ৩৪ ধারা অনুযায়ী দুই বছর পর্যন্ত মেয়াদের কারাদন্ড অথবা এক হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দন্ড একসঙ্গে হতে পারে।
২. শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োগ
কোন শিশুকে কোন ব্যক্তি যদি ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োগ করে অথবা কোন শিশুর দ্বারা ভিক্ষা করায় অথবা শিশুর হেফাজত, তত্ত্বাবধান ও দেখাশোনার জন্য দায়িত্বশীল কোন ব্যক্তি যদি ভিক্ষার উদ্দেশ্যে শিশুকে আলামত হিসেবে ব্যবহার করে তাহলে ১৯৭৪ সালের শিশু আইনের ৩৫ ধারা অনুযায়ী ওই ব্যক্তি এক বছর পর্যন্ত কারাদন্ড ও ৩০০ টাকা জরিমানা হতে পারে অথবা উভয় দন্ড হতে পারে।
৩. শিশুর দায়িত্বে থাকা অবস্থায় মদ পান
শিশু আইনের ৩৬ ধারায় বলা হয়েছে, কোন শিশুর লালন-পালনের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তি প্রকাশ্যে মদ পান করে মাতলামি করলে তাকে ১০০ টাকা জরিমানা করা যাবে। যত বার মদ পান করে মাতলামি করবে ততবারই তাকে অর্থদন্ডে দন্ডিত করা যাবে।
৪. শিশুকে মাদক বা বিপজ্জনক ওষুধ দেওয়া যাবে না
কোন শিশুকে অসুস্থতা বা অন্য কোন কারণে যথাযথ যোগ্যতাসম্পন্ন ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোন নেশা জাতীয় সুরা বা বিপজ্জনক ওষুধ দেওয়া হয় বা দিতে বাধ্য করা হয় তাহলে শিশু আইনের ৩৭ ধারা অনুযায়ী যে ব্যক্তি সুরা বা ওষুধ দিবে বা দিতে বাধ্য করবে, তার এক বছর পর্যন্ত মেয়াদের কারাদন্ড হতে পারে।
৫. সুরা বা বিপজ্জনক ওষুধ বিক্রির স্থানে প্রবেশ
সুরা বা বিপজ্জনক ওষুধ বিক্রির স্থানে কোন শিশুকে নিয়ে গেলে বা সেখানে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হলে বা কোন শিশুকে সেখানে যাওয়ার কারন ঘটালে দায়ী ব্যক্তিকে শিশু আইনের ৩৮ ধারা মোতাবেক পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা যাবে।
৬. বাজি ধরা বা ঋণ গ্রহণে উস্কানি দেওয়া
শিশু আইনের ৩৯ ধারায় বলা হয়েছে, কোন শিশুকে কোন বাজি ধরতে বা এ ধরনের কোন লেনদেন করতে বাধ্য করা হলে বা উস্কানি দেওয়া হলে বা উস্কানি দেওয়ার চেষ্টা করলে বা কোন শিশুকে ঋণ গ্রহণ করতে উস্কানি দেওয়া হলে দায়ী ব্যক্তিকে ছয় মাস পর্যন্ত কারাদন্ড দেওয়া যাবে।
৭. শিশুর থেকে কিছু কেনা
কোনো শিশুর কাছ থেকে কোনো দ্রব্য কেনা বা বন্ধক নেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। শিশু আইনের ৪০ ধারায় বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি শিশুর কাছ থেকে কিছু কিনবে বা বন্ধক রাখবে তাকে এক বছর পর্যন্ত কারাদন্ড দেওয়া যাবে। জরিমানাও করা যাবে।
৮. পতিতালয়ে থাকার অনুমতি
চার বছরের বেশি বয়স্ক শিশুকে পতিতালয়ে বাস করতে বা প্রায়ই যাতায়াত করতে সুযোগ বা অনুমতি কেউ দিলে তার দুই বছর পর্যন্ত বা যে কোনো মেয়াদের কারাদন্ড হতে পারে। শিশু আইনের ৪১ ধারা অনুযায়ী এই শাস্তি দেওয়া যাবে।
৯. অসৎ পথে পরিচালনা
শিশু বালিকাকে অসৎ পথে পরিচালনা করলে বা পতিতাবৃত্তিতে উৎসাহ দেওয়া হলে বা স্বামী ব্যতীত অন্য কোনো ব্যক্তি সঙ্গে যৌনমিলন করায় বা মিলনে উৎসাহ দেয় তাহলে দায়ী ব্যক্তিকে দুই বছর পর্যন্ত কারাদন্ড দেওয়া যাবে (শিশু আইনের ৪২ ধারা)।
১০. শিশু কর্মচারীকে শোষণ
যদি কেউ কোনো শিশুকে ভৃত্যের চাকরি অথবা কারখানা কিংবা অন্য প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকের কাজে নিয়োগ দেওয়ার ভান করে নিজ স্বার্থে শোষণ করে বা কাজে লাগায়, আটক রাখে বা শিশুর উপার্জন নিজে নেয় তবে তাকে এক হাজার টাকা জরিমানা দন্ডে দন্ডনীয় করা যাবে।
যদি কেউ একই উদ্দেশ্যে শিশুকে নিয়োগ দিয়ে তাকে অসৎপথে পরিচালিত করে, যৌনকর্মে লিপ্ত করে বা এমন কাজের ঝুঁকির সম্মুখীন করে তবে তাকে দুই বছর পর্যন্ত কারাদন্ড দেওয়া যাবে বলে শিশু আইনের ৪৪ ধারায় বলা হয়েছে।
১১. পলায়নে সহায়তা
সরকারি কোনো অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানে শিশু আটক থাকলে তাকে পলায়নে কেউ সহায়তা করলে বা সহায়তা করতে উৎসাহ দিলে ওই ব্যক্তির দুই মাস পর্যন্ত কারাদন্ড হতে পারে বলে শিশু আইনের ৪৫ ধারায় বলা হয়েছে। শিশুর প্রতি এই ধরনের নিষ্ঠুরতা চোখে পড়লে আপনিও জানাতে পারেন আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। আবার দেশে যে সব মানবাধিকার সংগঠন রয়েছে, সেসব সংগঠনের মানবাধিকার কর্মীকে খবর দিতে পারেন।
শিশু অধিকার আইন ও বাস্তবতা সম্পর্কে পড়ুন
লেখকঃ সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, এম.ফিল গবেষক ও আইনজীবী জজ কোর্ট, কুষ্টিয়া। E-mail: seraj.pramanik@gmail.com.
Discussion about this post