‘উকিল সাব, আমি আমার বউরে তালাক দিতে চাই’
‘কেন ভাই?’
‘ভাই, আমার বউ বিয়ের আগে থেকেই প্রেম করতো তার এলাকার এক ছেলের সাথে। বিয়ের পর এখনো সে ঐ ছেলের সাথে সম্পর্ক রেখেছে’
‘আপনি কীভাবে শিওর?’
‘আমি ওদের ফেসবুক ম্যাসেজ দেখছি’
‘ওনার ফেসবুক আপনি কীভাবে দেখলেন?’
‘ওর ফেসবুক পাসওয়ার্ড আছে আমার কাছে’
‘এটা আপনার স্ত্রী জানে?’
‘না’
‘আপনি কীভাবে আপনার স্ত্রীর ফেসবুক পাসওয়ার্ড জানলেন?’
‘আমি যখন দেশে ছিলাম তখন তার মোবাইল থেকে পাসওয়ার্ডটা চুরি করে নিয়ে নিয়েছি’
‘কেন?’
‘আমার বউ কার সাথে চ্যাট করে এটা জানা কি আমার জরুরী না?’
‘আপনার ফেসবুক পাসওয়ার্ড জানে আপনার স্ত্রী?’
‘না’
‘এর মানে হচ্ছে, আপনি আপনার স্ত্রীকে সন্দেহ করেন, অথচ আপনার স্ত্রী আপনাকে সন্দেহ করে না’
‘ভাই, আমি তো পরকীয়া করি না। কিন্তু আমার বউ তো পরকীয়া করতেছে। সে যদি আমার ফেসবুক পাসওয়ার্ড জানতো, তাহলে কিই বা হতো?’
‘আপনি যদি ওনার পাসওয়ার্ডটা না জানতেন, তাহলে কি হতো বলেন তো?’
‘ভাই, আপনি দেখি উল্টা কথা বলেন। আপনিও কি ঐসব লোকদের মতো নাকি?’
‘কোনসব লোক ভাই?’
‘ঐ যে নারীবাদী না নারীলোভী কি যেন বলে যে ওনাদের, যারা নিজেদের শিয়াল আর নারীদের মোরগ ভাবে, আর সারাদিন চ্যাঁচামেচি করে যেন মোরগ ঘরে না থেকে বাহিরে বাহিরে থাকে’
‘না না ভাই, আমি ঐরকম না। আমি বিশ্বাস করি, বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃকোড়ে আর নারী পর্দাতে’
‘কিন্তু আপনার কথাবার্তায় তো সেরকম গন্ধ পাই না’
‘আপনার নাকে আসলে সন্দেহের গন্ধ ঢুঁকে বসে আছে’
‘কীসের সন্দেহ?’
‘নিজেকে জ্ঞানী আর বাকী সবাইকে অজ্ঞানী ভাবার সন্দেহ’
‘বুঝলাম না। আমি কখন নিজেকে জ্ঞানী ভাবলাম? আর আমি আসছি ভাই এখানে তালাক দিতে, এতো জ্ঞান দিবেন না আমাকে। আমারও কম জ্ঞান নাই। আর, তাছাড়া দেশে উকিলের অভাব নাই। আপনি না পারলে বলেন, আমি অন্য উকিল দিয়ে তালাক করাবো’
‘পরকীয়া করা বউ না হয় তাড়াবেন তালাক দিয়ে, কিন্তু মনের সন্দেহ না দূর করলে তো পরে আবার যাকে বিয়ে করবেন তার ফেসবুক পাসওয়ার্ডও আপনি চুরি করবেন আর চুরি করে দেখবেন তারও কোন পরকীয়া প্রেমিক আছে কিনা?’
‘পরের বার বিয়ে করলে অবশ্যই খোঁজ খবর নিয়েই বিয়ে করবো’
‘একটা কথা বলবো?’
‘আপনি আর কি বলবেন, নারীবাদী চিন্তা ভাবনা ছেড়ে কিছু তো আপনারা চিন্তাও করতে পারেন না’
‘নবীজী (সাঃ) একটা বাণীতে বলেছেন, “তালাক হচ্ছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট তালাক”, তাই অনুরোধ করছি তালাকের আগে আরেকবার ভাবুন। আপনার স্ত্রীকে একবারের জন্য ভালো হবার সুযোগ দিন। তাছাড়া, যদি বাচ্চাকাচ্চা থেকে থাকে তার ভবিষ্যতের কথাও ভাবুন একবারের জন্য। দেখুন না, একবার ক্ষমা করে দিয়েই’
‘ভাই, আমি ক্ষমা করে দিলে আমি ঠকে যাচ্ছি না? আপনি কি পারবেন এমন কারো সাথে সংসার করতে যে অন্য কারো সাথে প্রেমখেলায় মেতে থাকে’
‘আমি না কখনো আমার বউয়ের ফেসবুক পাসওয়ার্ড চুরি করতাম, না তার সাথে কথা না বলে তালাক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতাম’
‘মানে?’
‘মানে আমার কোন সন্দেহ জাগলেই আমি সরাসরি তাকে সেটা বলে দিতাম। আমার পছন্দ অপছন্দ সব কিছু তার সাথে শেয়ার করবো, তার পছন্দ অপছন্দ আমি শুনবো। দুইজন দুই সাইড থেকে সেক্রিপাইজ করলে তখন সংসারটাকে আর ভাঙ্গতে হবে না। আমাদের ছোট ছোট ত্যাগ হয়তো, আমাদের সন্তানদের অনেক বড় কিছু ত্যাগ করা থেকে রেহাই দিবে। পশ্চিমে প্রচুর ডিভোর্স হয় বলেই তাদের সন্তানরা বাবা মা দুইজনের আদর পায় না। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা ভিন্ন। আমরা সন্তানদের বাবা মায়ের সাথে একসাথে রাখতেই সাচ্চন্ধ বোধ করি।’
‘তাহলে আপনি বলতে চান, আমি একটা দুশ্চরিত্রা মহিলার সাথে সংসার করি?’
‘ভাই, আপনার স্ত্রী আর আপনার মধ্যে পার্থক্য কোথায় তাহলে?’
‘মানে?’
‘আপনার স্ত্রী সন্তান, স্বামী, সংসারের চেয়ে যৌবনকে বেশী গুরুত্ব দিচ্ছে বলে আপনি বিদেশ থাকার সুযোগে পরকীয়া করতেছে, আর আপনিও আপনার সাথে সমঝোতা না করে, ক্ষমা না করে দিয়ে, তালাক দিতে চাচ্ছেন। কারন তালাক দিলে আপনি আরেকটা বিবাহ করতে পারবেন। তাহলে আপনি নিজেও কি যৌবনকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না? একবারও তো চিন্তা করছেন না যে, ছেলের দিকে তাকিয়ে স্ত্রীকে একবার ক্ষমা করে দিয়েই দেখি না। এমনও তো হতে পারে, আপনি সব জেনেও তাকে ক্ষমা করে দিচ্ছেন জেনে সে শুধরে যেতে পারে এবং সব ছেড়ে দিয়ে সুখের সংসার করতে পারে। একটা বার ভাবুন না প্লীজ, আপনার একটা সন্তান মাদক আসক্ত, তাকে সুস্থ করা সহজ নাকি একটা নতুন সন্তান জন্ম দেওয়া সহজ?’
‘নতুন সন্তান জন্ম দেওয়া সহজ’
‘না রে ভাই। একটা নতুন সন্তান জন্ম দিয়ে বড় করবেন, আর ইতিমধ্যে বড় হয়ে যাওয়া ছেলেটাকে শুধু আসক্তি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। তাছাড়া, আপনি অসুস্থ ছেলেকে সুস্থ করতে না পারলে আপনার নতুন সন্তান যে অসুস্থ হবে না তার কোন নিশ্চয়তা আছে কি?’
‘কিন্তু এটার সাথে আমার তালাকের সম্পর্ক কি?’
‘আপনি চাইলে আপনার স্ত্রীকে পরকীয়া থেকে সরিয়ে আনতে পারেন। নতুন বিয়ে করলে ঐ মেয়েকে যেসব শর্ত দিয়ে বিয়ে করবেন, সেগুলো আপনার বর্তমান স্ত্রীকে দিন। সংসার, ধর্ম, সন্তান এগুলো আগে মূল্যায়ন করুন। দেখবেন, আপনার স্ত্রীর শুভ বুদ্ধির উদয় হবে’
‘আর না হলে?’
‘আপনি বুঝিয়ে বলুন, ঠাণ্ডা মাথায় বলুন, আপনার ত্যাগ শুধু মাত্র পরিবারের জন্য এটা বলার দরকার নেই। বলবেন, তোমাকে ভালোবাসি আর তুমি আমি আর আমাদের সন্তানরা কখনো আলাদা হই, এটা আমি কখনো চাই না। তাই তোমার সবকিছু আমি ক্ষমা করে দিলাম। চলো নতুন করে সংসার করি’
‘কিন্তু সে যদি তারপরও ফেসবুক ব্যবহার করে?’
‘করলে?’
‘আমি যখন বলবো আমি তার ফেসবুক ম্যাসেজ থেকে পরকীয়ার খবর জানছি, তখন তো সে নিশ্চয়ই ফেসবুক পাসওয়ার্ড বদলে ফেলবে’
‘তো’
‘তখন পরকীয়া করলে বুঝবো কি করে?’
‘ওহ খোদা। আপনারা দুইজন একটা কাজ করুন, দুইজন ফেসবুক ব্যবহার বন্ধ করে দেন। এটাই আপনাদের সংসারের অশান্তি করছে’
‘আমি রাজি আছি ফেসবুক বন্ধ করতে’
‘আপনার স্ত্রীকে রাজি করান। রাজি হবে আশা করি।’
‘বউকে তালাক দিতে আসলাম আর এখন আপনি ফেসবুককে তালাক দেওয়াচ্ছেন’
‘আর দুইটা কথা ভাই’
‘জি বলুন’
‘প্রথমত, সন্দেহ মনে রাখবেন না।
দ্বিতীয়ত, স্ত্রীকে স্বপ্ন দেখান, সংসারের স্বপ্ন, ভবিষ্যতের স্বপ্ন, বাচ্চাকাচ্চা নাতিনাতনিদের স্বপ্ন।
তৃতীয়ত, মাঝে মাঝে ঘুরতে নিয়ে দূরে কোথাও। দেশের বাহিরে দরকার নাই, অন্তত জেলার বাহিরে নিয়ে যান।
চতুর্থত, ধর্মীয় অনুশাসন নিজে মানুন এবং স্ত্রী-সন্তানদেরকেও মানান।
পঞ্চমত, পরিবারকে সময় দিন। বাংলা নাটক দেখেন না নাকি, একটু রোমান্টিক হবেন স্ত্রীর সাথে। খিটখিটে মেজাজ নিয়ে বা গোমড়া মুখ নিয়েস্ত্রীর সাথে কথা বলবেন না।
ষষ্ঠত, একসাথে বসে রোমান্টিক নাটক সিনেমা দেখুন, রোমান্টিক বই পড়ুন। আবার পরকীয়া বা পর্ণ জাতীয় কিছু দেইখেন না।
সপ্তমত, স্ত্রীর সিদ্ধান্তও শুনুন মাঝে মাঝে। সবসময় আপনার সিদ্ধান্ত ওর উপর চাপিয়ে দিবেন না, দুইজনে পরামর্শ করেও সিদ্ধান্ত দিতে পারেন।’
‘আর কিছু নাই ভাই?’
‘আছে ভাই, বলতাম?’
‘বলেন’
‘এটা আপনার জন্য না। আপনার স্ত্রীর জন্য’
‘বলেন’
‘ওনাকে বলবেন যে, পরের বউয়ের প্রতি আদর, সোহাগ, ভালোবাসা দেখানোর মতো মৌমাছির অভাব থাকে না। পরের স্ত্রীকে ভাগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো কাপুরুষেরও অভাব নাই। কিন্তু পরের বউ ভাগিয়ে নিয়ে নিজের বউয়ের মতো মর্যাদা দিয়েছে এমন পুরুষের বড্ড অভাব। আর যে ভালোবাসার অভাব বলে পরপুরুষের হাত ধরছেন, তার কি ভালোবাসা দেওয়ার খেয়াল নাকি শুধু শরীর ভোগ করার খেয়াল সেটা একবারও চিন্তা করে দেখেছেন?’
‘এটা ভাই ঠিক বলছেন খুব’
‘হুম’
‘ভাই আমাকে বললেন, আমার স্ত্রীকে বললেন, কিন্তু ঐ হারামির বাচ্চাদের সম্বন্ধে কিছু বলবেন না?’
‘হারামির বাচ্চা আবার কারা?’
‘ঐ যে তারা নিজেদের কুলাঙ্গার দাবী করে, অন্যের বউয়ের প্রতি যাতে অঢেল প্রেম, তাদেরকে আমার মনে হয় ধর্ষকের চেয়ে কম ঘাতক হিসেবে দেখা উচিত না। ধর্ষক একটি মেয়ের জীবন নষ্ট করে আর এই পরকীয়া প্রেমিকরা একটা সংসার/পরিবারকে ধ্বংস করে দেয়। আর প্রবাসীর স্ত্রীদের সাথে পরকীয়া প্রেম তো তাদের ব্যবসা। এতে ভালো ইনকামও হয়ে যায় তাদের।’
‘খুব ভারাকান্ত মন নিয়ে এসেছিলাম আপনার কাছে। এখন প্রশান্তি নিয়ে যাবো বউ আর বাচ্চার কাছে’
‘শেষে একটা কথা বলি?’
‘জি অবশ্যই বলেন স্যার’
‘রাগ করবেন না তো?’
‘না স্যার, খোদার কসম’
‘দুই টিন বছর পর ২/৩ মাসের জন্য না এসে, প্রতি বছর অন্তত একবার দেশে আসার চেষ্টা করেন মিয়া। এক মাসের জন্য হলেও আসেন।’
‘ঠিক আছে স্যার। চেষ্টা করবো’
‘ঠিক আছে যান তাহলে আজ। আর ভাবী আপনার কথা যদি মানে তাহলে একদিন বাসায় দাওয়াত দিয়েন’
‘অবশ্যই স্যার। আপনাকে বাসায় একদিন দাওয়াত করে খাওয়াবো না এটা কি হয়?’
‘না ভাই, আমি দাওয়াত খাওয়ার জন্য যাবো না।’
‘তাহলে?’
‘আমি যাবো ঐ ছেলের বিরুদ্ধে ব্যভিচারের মামলা করতে, ভাবীর জবানবন্দী নিতে হবে তো’
‘সত্যি ভাই?’
‘হ্যাঁ ভাই। পরকীয়া শুধু আপনার সংসারের শত্রু না, এরা গোটা দেশ এবং সমাজের শত্রু’
‘ভাই এতক্ষণে কলিজা পুরা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে’
‘ভাই আপনারা মাথায় ঘাম পায়ে ফেলে দেশের অর্থনীতি সচল রাখছেন, আর তারা আপনাদের সংসার ভাঙবে, এটা অন্তত আমরা হতে দিবো না। ইনশাআল্লাহ্’
‘ধন্যবাদ ভাই’
‘আপনাকেও ধন্যবাদ’
লেখকঃ চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক
Discussion about this post