পাঠকের পাঠানো লেখা
বিডি ল নিউজঃ শুনেছিলাম হিটলার নাকি জার্মানিতে ক্রিকেট নিষিদ্ধ করেছিল সময় অপচয়ের অভিযোগ এনে। হিটলার নাকি একদিন অফিস যাওয়ার পথে দেখলেন সাদা পোশাকে দুইটি দল বল, ব্যাট, স্ট্যাম্প দিয়ে আবার একটা বাউন্ডারি দিয়ে কিছু একটা খেলছে। তখন দর্শকের মধ্যে একজনকে হিটলার জিজ্ঞাসা করল যে, তারা কি খেলছে? উত্তরে জানতে পারল, এটা ক্রিকেট খেলা। তখন তিনি কিছুক্ষণ খেলাটা বুঝার চেষ্টা করে না বুঝে চলে গেলেন। বিকেলে ফেরার পথে তিনি দেখলেন ক্রিকেট নামক ঐ খেলাটা তখনো চলছে। তিনি ভাবলেন সন্ধ্যা নামলেই হয়ত শেষ হয়ে যাবে। তাই তিনি কৌতূহল না দেখিয়ে বাসায় চলে গেলেন। পরের দিন তিনি যখন আবার ঐ পথে অফিসে যাচ্ছিলেন তখন দেখলেন ক্রিকেট খেলাটা তখনো চলছে। অবাক হয়ে তিনি গাড়ি থেকে নেমে একজন দর্শককে জিজ্ঞাসা করলেন, কি ব্যাপার খেলাটা এখনো শেষ হয়নি কেন? তখন দর্শক বললেন, সবে তো দ্বিতীয় দিন চলছে, খেলা শেষ হবে পাঁচ দিন পর। হিটলার তো অবাক হলেনই পাশাপাশি চিন্তা করলেন ফুটবল কোথায় ৯০ মিনিটে শেষ হয়ে যায়, সেখানে ৫ দিন লাগিয়ে ক্রিকেট, এ আবার কেমন খেলা। তিনি কথা না বাড়িয়ে অফিসে চলে গেলেন। এইভাবে কেটে গেল আরও তিন দিন। হিটলার ঠিক করলেন পঞ্চম দিন, অর্থাৎ টেস্টের শেষ দিন তিনি খেলার ফলাফল জানার পাশাপাশি খেলাটা বুঝার চেষ্টা করবেন। প্ল্যানমত তিনি শেষ দিনের খেলা দেখার জন্য শেষ বিকেলের আগেই মাঠে পৌঁছে গেলেন। কিছুক্ষণ খেলা দেখার পর তিনি আম্পায়ার ইশারা দিলেন খেলা শেষ, খেলোয়াড়রা একে অন্যের সাথে হাত মেলাচ্ছে। তখন হিটলার দর্শক সারির একজনকে জিজ্ঞাসা করলেন, খেলায় কোন দল জিতল? উত্তর শুনে তো হিটলার অবাক। ৫ টা দিন খেলার পর নাকি খেলার কোন ফলাফল হয় নি, খেলা ড্র। তখনই চটে গেলেন হিটলার। আর, সাথে সাথে জার্মানিতে নিষিদ্ধ করলেন ক্রিকেট। এই ছিল জার্মানিতে ক্রিকেট মৃত্যুর গল্প। অনেকটাই শোনা গল্প, যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। হিটলার যদি একদিনের আন্তর্জাতিক কিংবা টি২০ ক্রিকেট দেখে যেতেন, তবে হয়ত ক্রিকেট এখনো জার্মানিতে প্রচলিত থাকতো।
যাই হোক জার্মানিতে ক্রিকেট তথা টেস্ট ক্রিকেট নিষেধাজ্ঞার কারনে মৃত্যুবরণ করলেও উপমহাদেশে কোন নিষেধাজ্ঞা ব্যতীতই কেবল অবহেলাজনিত কারনে মৃত্যু ঘটতে পারে টেস্ট ক্রিকেটের। আর উপমহাদেশে টেস্ট ক্রিকেটের মৃত্যু মানে ক্রিকেট থেকেই টেস্টের মৃত্যু। কেননা, ক্রিকেটের জন্য এখন উপমহাদেশ অবিচ্ছেদ্য। অথচ, সেই উপমহাদেশ এখন ডুবছে টি২০ মত টাকা এবং শক্তির খেলায়। ওডিআই চলছে, তবে সেটাও ম্লান টি২০’র কাছে। কোথায় ক্রিকেট ছিল কৌশলের খেলা, সেখানে ক্রিকেট এখন ক্যারিবিয়ান প্লেয়ারদের গায়ের জোরের খেলা হয়ে গেছে। ক্রিকেটীয় ব্যাকরণের প্রয়োগ নেই বললেন চলে। টি২০ প্রিমিয়ার লীগগুলো যে হারে টাকা ঢালছে, তাতে খেলোয়াড়রাও লোভ সামলাতে ব্যর্থ। ৪/৫ বছর আগেও দেখা গেছে গ্রেট ক্রিকেটাররা ওডিআই থেকে অবসর নিলেও চালিয়ে যেতেন টেস্ট ক্যারিয়ার। আর এখন উল্টো টি২০ লীগ খেলার জন্য মাঝে ক্যারিয়ারে দাঁড়িয়েই সরে দাঁড়াচ্ছেন টেস্ট থেকে। টাকার কাছে মার খেয়ে যাচ্ছে উপমহাদেশের টেস্ট ক্রিকেট।
খেলোয়াড়দের লোভের পর কিছু দোষ যে দর্শকের নেই, তা কিন্তু নয়। ওডিআই আর টি২০ তে যে হারে দর্শক পাওয়া যায়, টেস্টে তার এক-তৃতীয়াংশ পাওয়াও মুশকিল। আর এটা উপমহাদেশেই বেশী সম্ভব। ২০১৫ বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ঠিক আগ মুহূর্তে অস্ট্রেলিয়াতে বিগ ব্যাস এবং অস্ট্রেলিয়া বনাম ভারতের টেস্ট সিরিজ হচ্ছিল। মজার এবং শেখার ব্যাপার হচ্ছে, বেশী দর্শক টেস্ট দেখতে এসেছিল। বিগ ব্যাস টেস্টের কাছ দর্শক হারিয়েছে, এটা বোধ হয় উপমহাদেশে দুঃস্বপ্নেও দেখা যায় না। স্বীকার করুক আর নাই করুক, উপমহাদেশে টেস্ট ইংল্যান্ড কিংবা অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে অনেক বেশী পিছিয়ে। টেস্ট মানসিকতায় তাদের চেয়ে অনেক বেশী পিছিয়ে থাকাও স্বাভাবিক। ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া টেস্ট খেলে শত বছর আগে থেকে, যেখানে বাংলাদেশ টেস্ট খেলে মাত্র ১৫ বছর। বছরে টেস্ট খেলার সংখ্যাও একেবারে নগণ্য। জনপ্রিয়তাও কমছে দিনকে দিন। টেস্টের জনপ্রিয়তায় প্রথম ধাক্কা দিয়েছে ওডিআই। এতদিন বিভিন্ন সিরিজ, বিশ্বকাপ দিয়ে সেই জনপ্রিয়তা তুঙ্গে থাকলেও ওডিআইও এখন মার খেয়ে যাচ্ছে টি২০’র কাছে। আর এর জন্য সব চেয়ে বড় ভূমিকা পালন করছে উপমহাদেশের দর্শকই। টি২০ দেখতে যে দামে টিকিট কিনছে, সেই হিসেবে প্রায় ফ্রিতেও গিয়ে টেস্ট দেখতে রাজি নন এই অঞ্চলের দর্শকরা। যেখানে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়াতে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শেষ বয়সী বৃদ্ধাদের টেস্ট দেখতে আসতে দেখা যায়, সেখানে উপমহাদেশে টেস্টের পঞ্চম দিনেও গ্যালারীর বিশাল অংশ ফাঁকা দেখা যায়। বলতে বাধা নেই, এই দর্শকই টেস্টকে গলা টিপে মারছে।
টেস্টের রোমাঞ্চ বুঝতে না পারাও একটা বড় সমস্যা। ক্রিকেটের মজাই হচ্ছে চার, ছক্কা, আউট এই তিনটিই। সেখানে টেস্টের মজা হচ্ছে ডট বল, কাপ্তানের জুয়া খেলা, ফলঅন, অনেক বেশী শ্লিপ, স্লেজিং ইত্যাদি। যেগুলো অনেক দর্শকই বুঝতে পারবে না। প্রায় ৪৫০ ওভারের খেলা যে ধৈর্য প্রদর্শনের বিশাল লড়াই, তাতে কোন সন্দেহ নেই। একজন লোক বড়শী বাইতে বসলে তিনি শুধু মাছই ধরেন না, রীতিমত নিজের ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে থাকেন। তবে, এখানে তার একটা উদ্দেশ্য থাকে; সেটা হচ্ছে মাছ ধরা। মাছ পেলেই উনি সার্থক। তবে হ্যাঁ টেস্ট খেলা উনার জন্যও নয়। টেস্ট খেলা হচ্ছে ওনার জন্য যিনি এতক্ষণ কোন স্বার্থ ছাড়াই চুপচাপ ঐলোকের বড়শীতে মাছ ধরা দেখেছেন। এবার বুঝেন টেস্ট খেলা দেখা আর টেস্ট খেলা দেখা দুই হচ্ছে নীরবে নির্বিঘ্নে নিজের ধৈর্য পরীক্ষা করা।
ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার মধ্যেকার অ্যাশেজ সিরিজ ছাড়া টেস্ট খেলার কোন বড় আসর নেই। দুই বছর পর পরই টি২০ বিশ্বকাপ হচ্ছে। তাছাড়া টি২০’র জন্য তো প্রত্যেক দেশেই প্রিমিলার লীগ আছে। ওডিআই বিশ্বকাপও হচ্ছে চার বছর অন্তর অন্তর, সাথে একই সময় ব্যবধানে হচ্ছে চ্যাম্পিয়নস লীগ। অথচ, টেস্ট কেবল দুইটি দেশের মধ্যে কোন সিরিজ হলে দুই একটা টেস্ট ম্যাচের ব্যবস্থা করা হয়। মাঝে মাঝে কিছু কিছু দল শুধু টেস্ট সিরিজ খেলে, তিনটা চারটা ম্যাচের জন্য। দেখা যায়, মাত্র দশটা টেস্ট খেলুড়ে দেশ হওয়া সত্ত্বেও একটা দেশের সাথে আরেকটা দেশের ৫/১০ বছর সাদা পোশাকে দেখা যায় না। এটা স্বাভাবিক যে, দুইটা দেশ নিজেদের মধ্যে ৪/৫ বছরের মধ্যেই সিরিজ খেলে। সেখানে ওডিআই, টি২০ থাকে, মাঝে মাঝে টেস্টও থাকে। ঐসব সিরিজ না হলেও বিভিন্ন টুর্নামেন্টে ঠিকই দেখা হচ্ছে। যেমন, বিশ্বকাপে টি২০ কিংবা ওডিআই খেলতে পারছে একে একে সব দলের বিরুদ্ধে। অথচ অবহেলায় কেবল ক্রিকেটের সবচেয়ে প্রাচীন ফরম্যাটে। টেস্ট নিয়ে কোন টুর্নামেন্ট থাকলে হয়ত এমন হত না। তবে, টেস্ট নিয়ে বিশ্বকাপের চিন্তা অনেকবার আইসিসি করলেও সেটা সত্যি অনেক কষ্টদায়ক। তাই টেস্ট বিশ্বকাপ সম্ভব নয়। কেবল টেস্ট রেংকিং নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। তবে, এখন সময় এসেছে টেস্টটাকে গুরুত্ব দেওয়া। ক্রিকেট যে পেশীশক্তির খেলায় নয়, এটা যে সম্পূর্ণ টেকনিকের খেলা সেটা প্রমান করতে টেস্টকে আরও বেশী জনপ্রিয় করতে হবে। অন্তত ক্রিকেটপ্রিয় উপমহাদেশে সেটা করা উচিত এবং সম্ভব।
টেস্ট বিশ্বকাপ সম্ভব না হলেও কেবল উপমহাদেশের দলগুলোর মধ্যে ওডিআইতে এশিয়া কাপের আদলে উপমহাদেশ কাপের আয়োজন করা যেতে পারে। উপমহাদেশে কেবল চারটি দলই টেস্ট খেলছে। বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, ভারত, পাকিস্থান। এই চার দলের মধ্যে একটি টেস্ট টুর্নামেন্টের আয়োজন করলে উপমহাদেশে টেস্টের প্রচলনটা অনেক বেশী হারে বেড়ে যেতে পারে। ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া যেমন মর্যাদার লড়াইয়ের নামে ৫টি টেস্ট ম্যাচের মধ্য দিয়ে অ্যাশেজ সিরিজ খেলে থাকে, তেমনিভাবে উপমহাদেশ নিজেদের মধ্যে মর্যাদার লড়াই করতে পারে ব্যাটে বলের লড়াইয়ে এই উপমহাদেশ কাপের মাধ্যমে। অ্যাশেজ সিরিজ খেলা হয় ডিসেম্বর-জানুয়ারি সিজনে প্রায় ১৮ থেকে ৩০ মাস পর পর। আমরাও একই সময়ে দুই বছর পর পর উপমহাদেশ কাপের আয়োজন করতে পারি। যেহেতু চারটি দল, সেহেতু একসাথে দুইটি মাঠ ব্যবহার করতে হবে। দুইটি মাঠে একই সময়ে দুইটি অন্য দুইটি দলের বিরুদ্ধে টেস্ট খেলবে। তারপর বিপক্ষ দল পরিবর্তন হবে, এইভাবে একে একে সবাই সবার বিরুদ্ধে খেলবে। এরপর পয়েন্ট হিসেবে প্রথম দুই দল ফাইনাল খেলবে। আমার বিশ্বাস এমনিতে টেস্ট আগ্রহ না থাকলেও উপমহাদেশ কাপে যথেষ্ট আগ্রহ প্রকাশ করবে উপমহাদেশের ক্রিকেটপ্রেমী দর্শক। তাছাড়া ১মাস ব্যাপী এই টুর্নামেন্টে একসাথে উপমহাদেশের সবগুলো দলের সাথে অন্তত একটি করে হলেও টেস্ট খেলা হয়ে যাবে, যা হয়ত বছর পাঁচেকেও সম্ভব হয়ে উঠে না।
ছবিতে আমি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটু ফিকচার ড্রাফট করে দিলাম। আশা করি পাঠকের বুঝতে সহায়তা করবে।
লেখকঃ তানবীর চৌধুরী
ইমেইলঃ tanvir921535513@gmail.com
Discussion about this post