সাঈদ চৌধুরী:
এখন সব শান্ত হয়ে গেছে । চারিদিক নিস্তবদ্ধ ! শুধু সামান্য ব্যথা আর বুকের কষ্টগুলো জড়ো হয়ে পাহাড় সমান হয়ে আছে । পেটের নিচের অংশে দশ মাস ধরে বয়ে নিয়ে চলা প্রাণের অস্তিত্ব ভূমিষ্ট হওয়ার পর এখন স্তনের দুধ চুষে বের করে খাওয়ার কথা ছিল । কিন্তু সেই সন্তান মায়ের পাশে নেই । আমি বাবা হিসেবে আমার স্ত্রীর সন্তান সম্ভাবা হওয়ার সময়ের কষ্টটা দেখেছি । সে উঠতে গেলেও আমার সাহায্য নিত, ভাত খেতে গেলে ঠিকভাবে বসতে পারতোনা । কষ্ট দেখে আমার চোখে পানি আসতো !
কিন্তু যে নারীর পাশে এই সময়ে তার স্বামী থাকেনা তার অবস্থা কেমন হয় তা কি একবার চিন্তা করতে পারেন । দরকার নেই চিন্তা করার । এদেশে এভ্রিলের মত একজন নারীকে নিয়ে মনের দেয়াল, ফেইসবুকের দেয়াল অথবা মদ্যপ থেকে বারের প্রতিটি কোণের দেয়ালে ছবি একে ঝুলিয়ে দিতে পারার মানুষের অভাব নেই !
কিন্তু যে নারী গর্ভবতি হয়ে স্বামী হারার খেতাব পায় সে নারী যখন বাচ্চা প্রসব করে তখন তার ঠিকানা হয় রাস্তায়! হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে একটি প্রাণকে বাঁচানোর মায়ের আকুতি কোন জায়গায় প্রতিধ্বণি হলনা । কি অবাক বিষয় তাইনা ?
অভিযোগ উঠেছে তিনটি হাসপাতালের বিরুদ্ধে । শোনা যাচ্ছে মাত্র 1500 টাকা ঘুষ না দিতে পারায় ভর্তি হতে পারেনি এই স্বামী পরিত্যাক্তা নারী !তারপর তার সন্তান হল রাস্তায় সর্ব সম্মুক্ষে !
আমার প্রশ্নটা আসলে কারও বিরুদ্ধে নয় । আমি জানতে চাই যে সময় নারীটি রাস্তায় ব্যথায় কাতরাচ্ছে সে সময়কি একজন প্রতিষ্ঠিত মানুষও ওখান দিয়ে যাননি ? অথবা এমন কেউ কি ছিলনা যে ঐ নারীকে হাসপাতালে দায়িত্বরত ডাক্তারের কাছে সরাসরি স্থাপন করে দিয়ে আসবে !
আচ্ছা সব বাদ দিলাম একজন ডাক্তারও কি ঐ সময় হাসপাতালের সামনে দিয়ে যায়নি ? আমাদের দৃষ্টি কতটা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত তাইনা ? অবাক হওয়ার মত একটি ব্যপার হল এখন তদন্ত কমিটি হবে, অনেককে দোষারোপ করে অনেকেই বেঁচে যাবে, আবার এমন হবে হয়ত যে আসল দোষী সে কোন কথায়ই আসবে না !
এত বড় একটি সত্য ঢাকা পড়ে যাবে, জানেন কেন? শুধু সে ভাগ্য বিরম্বিত একজন নারী বলে ? গত বছর ঠিক এই সময়েই এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে নৈরাজ্য হয়েছিল । এ্যাম্বুলেন্সের ধাক্কায় মারা গিয়েছিল দুজন এবং আহত হয়েছিল আরও তিনজন । অনেক অনিয়ম বেড়িয়ে আসে তখন এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে । কিন্তু সমাধান ?
হয়ত আবার কোনদিন দেখবেন এ্যাম্বুলেন্সের অভাবে কেউ তার ভালোবাসার স্ত্রীকে অথবা মাকে বা বাবাকে বাঁচাতে পারেনি ।
আসলে এভাবেই চলছে । অভিনয় করে টাকা চেয়ে টাকার বিনিময়ে সেবা দিয়ে যারা ভালো সাজার অভিনয় করে যাচ্ছে তা প্রকাশ হওয়ার জন্য যুগে যুগে কিছু সুবিধা বঞ্চিত নামধারী মানুষগুলোর কাতর কন্ঠ আর আহাজারি শুনতে হয় আমাদের ।
ভালো মানুষ খুঁজবেন ? কিন্তু তার পকেটেতো টাকা নেই । সোহেল নাম করে যে ছেলেটি এত কষ্ট করে নারী কে নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে দৌড়ালো কি প্রাপ্তি তার দিন শেষে । লোকারণ্যে মানব মিশুর জন্ম হল, দুমিনিটের মাথায় সবাই মিলে আমরা হত্যা করলাম তাকে এবং পরে সেই নারীকে সেবা দেওয়ার অভিনয়ের জন্য হাসপাতালের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হল !
একটি মানুষের দাম আসলে আমরা কত কমাবো । প্রসব বেদনা উঠলে কেমন লাগে একজন নারীর তা কনসালটেন্ট ডা. নিলুফা অনুভব করলেন না ?(সূত্রঃ ভোরের কাগজ 18.10.2017) । 1500 টাকা যেখানে অনুভবের সাথে পার্থক্য করে দেয় সেখানে মানবতা শব্দটি আসলে খুব হাস্যকর । সবাই যদি শুধু ডিউটির জন্যই ডিউটি করে তবে শিক্ষার সাথে মাবকিতার সম্পর্কের দরকার নেই বলেই মনে করি ।
পারভিন নামের অভাগা মায়ের সন্তানকে বাঁচাতে পারেনি কোন হাসপাতাল এ দায় আসলে কি শুধু হাসপাতালের নাকি প্রতিটি মানুষের?
শিক্ষক ক্লাসে ঘুমোচ্ছে ছবিটি দুদিন যাবৎ ভাইরাল হয়েছে গণমাধ্যম গুলোতে । ডা. নিলুফা খুব হালাকাভাবে নিয়ে পারভিনকে বের করে দিলেন হাসপাতাল থেকে ।কিছুদিন আগে প্রধান নৌ প্রোকৌশলী দুর্নীতির কারণে ঘুষ সহ হাতেনাতে গ্রেফতার হলেন দুদকের পুলিশ টিমের কাছে !
কত কত টাকা এদের ! কত শত পরিচয় এদের ! লবিং, পরিচয়, কালো টাকার সংমিশ্রনে যারা আজ সমাজ পতি নামক বিশেষন যুক্ত করেছে নিজের নামের আগে তাদের মুখে মৃত শিশুটির লাথি কি অনুভব করছেন কেউ ?
মানবতা যদি এভাবেই দুমরে মুচরে যায় আর একটি করে তদন্ত কমিটি গঠনই হয় তার সমাধান তবে মানুষ বলে পরিচয় আসলে কোথা গিয়ে দেব আমরা ? আসুন বিলাপ করে কাঁদি কেউ একবার মানুষ বলে স্বীকৃতি দিলে সামান্য অধিকারগুলো পাওয়ার অপেক্ষায়….
Discussion about this post