রাজস্ব সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তির দীর্ঘসূত্রতা এড়াতে ২০১২ সালে সরকার চালু করেছিল বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর বা সালিশি পদ্ধতি) ব্যবস্থা। এটি চালু হওয়ার পর আয়কর সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তিতে তুলনামূলক ভালো সাফল্য এসেছে। গত চার বছরে এডিআরে আসা আয়কর সংক্রান্ত মামলার ৭৮ শতাংশই নিষ্পত্তি হয়েছে। এতে জড়িত রাজস্বের পরিমাণ সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকার বেশি। আর নিষ্পত্তি হওয়া রাজস্ব সংক্রান্ত মামলার বলতে গেলে প্রায় সবই আয়কর সংক্রান্ত।
এনবিআরের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, নিষ্পত্তি হওয়া রাজস্ব সংক্রান্ত মামলা ৯৮ শতাংশের বেশি আয়কর সংক্রান্ত। মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও শুল্ক সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তিতে এডিআর ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত কার্যত ব্যর্থ। এর মধ্যে আয়কর সংক্রান্ত মামলা বিকল্প উপায়ে নিষ্পত্তিতে সন্তুষ্ট এনবিআর। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এডিআর ব্যবস্থায় বিদ্যমান কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। বিশেষত শুল্ক ও ভ্যাট সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তিতে বিরোধ নিষ্পত্তিতে সহায়তাকারীদের (ফ্যাসিলিটেটর) ক্ষমতাও কম। ফলে এতে কার্যকর ফল আসছে না। এসব সমস্যা সমাধান করতে পারলে মামলায় আটকে থাকা প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকার রাজস্বের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সরকারের ঘরে আসবে বলে আশা করছেন তারা।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, আয়কর বিষয়ে এ পর্যন্ত ৬৫০টি মামলা এডিআরের মাধ্যমে নিষ্পত্তির জন্য ফ্যাসিলিটেটরদের কাছে আনা হয়েছে। এতে রাজস্ব জড়িত ছিল ৭ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা। এসব মামলার মধ্যে ৩৮৪টি মামলা নিষ্পত্তিতে উভয় পক্ষের (এনবিআরের সংশ্লিষ্ট কমিশনারেট ও করদাতা) মতৈক্য হয়েছে। অন্যদিকে ১২৩টি মামলায় আংশিক মতৈক্য হয়েছে। বাদবাকি ১১৯টি মামলা অমীমাংসিত রয়েছে। আর বর্তমানে বিচারাধীন রয়েছে ২৪টি মামলা।
আদালতের বাইরে সালিশি ব্যবস্থায় মামলা নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ২০১২ সালে এডিআর ব্যবস্থা চালু করে সরকার। মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে ফ্যাসিলিটেটরের দেওয়া রায় উভয় পক্ষ সম্মত হলে তবেই মামলাটি নিষ্পত্তি হয়েছে বলে গণ্য হবে। আইনগতভাবেও এর ভিত্তি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো পক্ষ একমত না হলে ওই মামলা এডিআরে নিষ্পত্তি হবে না মর্মে গণ্য হবে। ফলে মামলাটি যথানিয়মে আদালতে নিষ্পত্তি হবে।
এডিআরের অন্যতম ফ্যাসিলিটেটর ও এনবিআরের সাবেক সদস্য সৈয়দ আমিনুল করিমের হাত ধরে বেশ কয়েকটি আয়কর সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। ইত্তেফাককে তিনি বলেন, আয়কর সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তি এডিআর ভালো ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু বড় অঙ্কের রাজস্ব আটকে থাকা ভ্যাট ও শুল্ক সংক্রান্ত মামলায় কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি নেই এডিআরে। সেখানে নজর দিতে হবে।
অনেক সময় এনবিআরের কর্মকর্তারা শুল্ক, ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) কিংবা আয়কর বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত দেন তা করদাতার কাছে আইন কিংবা বিধি সম্মত না হলে তিনি এনবিআরে আপিল করতে পারেন। অন্যথায় আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন। আবার কোনো পণ্যের মূল্য সম্পর্কে মতভিন্নতা, পরিমাণ ও ঘোষণায় অনিয়ম, আমদানি নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না, বন্ড সুবিধার অপব্যবহার হলো কিনা এমন কিছু কারণে এনবিআর ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে মতবিরোধ তৈরি হতে পারে। আবার ভ্যাটের ক্ষেত্রে অবৈধ রেয়াত গ্রহণ, উত্পাদন বা সেবা প্রদানকারী কর্তৃক ঘোষিত মূল্য, ভ্যাট সম্পর্কিত দলিলাদি যথাযথভাবে সংরক্ষণ না করা, অসত্য তথ্য সম্বলিত নথি দাখিল, ভ্যাট চালানপত্র না দেওয়া, উেস কর আদায় ও প্রদান না করা এবং সময়মত ভ্যাট প্রদান না করার কারণে বিরোধ তৈরি হতে পারে। এক্ষেত্রে এনবিআরের কর্মকর্তারা যে কোনো সিদ্ধান্ত দিলে তাতে সংক্ষুব্ধ হয়ে করদাতা কিংবা ব্যবসায়ী আদালতে যান। এসব কারণে রাজস্ব সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা বেড়ে গেছে। এনবিআর হিসাবে প্রায় ২৫ হাজার মামলায় ৩১ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব মামলায় আটকে আছে। সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আটকে রয়েছে ভ্যাট সংক্রান্ত মামলায়। এ খাতে ৩ হাজার ২২৬ মামলায় ১৭ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকার রাজস্ব আটকে রয়েছে। এর বাইরে আয়কর খাতে ৩ হাজার ৮৭৬ মামলায় ৮ হাজার ১৮৩ কোটি টাকা ও শুল্ক সংক্রান্ত ১৭ হাজার ৪৭০ মামলায় ৪ হাজার ৮২৫ কোটি টাকার রাজস্ব আটকে রয়েছে।
আদালতে বিচারাধীন মামলা এডিআরের মাধ্যমে নিষ্পত্তিতে গুরুত্ব দিয়েছেন প্রধান বিচারপ্রতি এস কে সিনহা। এ জন্য এডিআর ব্যবস্থার সংশোধন করে এটি সহজ করার পক্ষেও মত দেন তিনি। গত বছর এনবিআর আয়োজিত এক আলোচনা সভায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মামলা বিকল্প উপায়ে নিষ্পত্তির উদাহরণ টেনে আমাদের দেশেও এ ব্যবস্থাকে কার্যকর করার তাগিদ দেন। সূত্র: ইত্তেফাক
Discussion about this post