দণ্ডবিধির ২৯৫ থেকে ২৯৮ ধারায় মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, উপাসনালয় ভাঙচুরের বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া আছে এবং শাস্তির বিধান উল্লেখ থাকলেও কী কী কারণে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ আনা যেতে পারে তা বলা নেই। ধর্মীয় অনুভূতির সংজ্ঞা কী হবে সে বিষয়েও স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। ধর্মীয় অনুভূতির কোনও সংজ্ঞা এখনও দেশের প্রচলিত আইনে অস্পষ্ট। ২৯৫ ধারায় জেল-জরিমানার কথা বলা হয়েছে। ২৯৫ এর ‘ক’ ধরার অপরাধ অজামিনযোগ্য। আইনজীবীরা বলছেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে এই আইনের প্রয়োগ হচ্ছে প্রতিপক্ষকে ‘হয়রানির হাতিয়ার’ হিসেবে।’
‘দণ্ডবিধির ২৯৫ এর ‘ক’ ধারা মতে, কোনও শ্রেণির ধর্মীয় বিশ্বাসকে অবমাননা করে ওই শ্রেণির ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার উদ্দেশ্যে দুরভিসন্ধিমূলক কাজ করা হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ওই ধারায় আরও বলা হয়েছে, ‘ম্যাজিস্ট্রেট মামলা আমলে নিতে পারবেন। আর এ ধারার অপরাধ জামিন-অযোগ্য।’
আইনজীবীদের অভিমত, সুনির্দিষ্টভাবে কারও ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে মন্তব্য করলে তার শাস্তির বিধান রয়েছে দণ্ডবিধির ২৯৭ ধারাতেও। তবে সাম্প্রতিক সময় তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারাতে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের বিষয়ে বলা হলেও সেখানেও কিছুই স্পষ্ট করা হয়নি। ধর্মীয় অনুভূতি বলতে কী বোঝাচ্ছে, তা স্পষ্ট করে বলা নেই। তাই তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় এ বিষয়ে কিছু করার নেই। কাউকে উদ্দেশ্যমূলক আঘাত করার বিষয়টি এখনে অস্পষ্ট। কারণ কার কোন কথাতে কে আঘাত পাচ্ছেন, সে বিষয়েও কিছু বলা নেই। তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনও ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েব সাইটে বা অন্য কোন ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনও ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি প্রদান করা হয়, তাহা ইহলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ।’
তবে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মামলা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতেই এই আইন বেশি ব্যবহার হচ্ছে বলে জানান ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া। তিনি বলেন, ‘মামলায় গিয়ে দেখেছি, যতোটা না একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ধর্ম বুঝে আইনের আশ্রয় নিচ্ছেন, তার চেয়ে বেশি মামলা হচ্ছে প্রতিপক্ষকে হয়রানি করতে। আমাদের দেশে বিগত বছরগুলোতে ধর্মীয় অনুভূতি বলতে কেবলমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের অনুভূতি বোঝানো হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সেকুলারিজম (ধর্মনিরপেক্ষতা) আর ধর্মহীনতা দু’টো দুই জিনিস। দু’টি দলকে কট্টর উল্লেখ করে তিনি বলেন, ধর্মহীন যাদের বলা হয় তারা এবং যারা ধর্মপালনকারী দুই দলই এতো কট্টর যে, অন্য কোনও কিছুকেই তারা মানতে নারাজ। ফলে এক অসহিঞ্চু ব্যবস্থার মধ্যে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। যা আইনি কাঠামোর মধ্যদিয়ে পরিত্রাণ পাওয়া খুব সহজ নয়। এজন্য দরকার দীর্ঘদিনের চর্চা ও শিষ্টাচার।’
‘শিক্ষার আলো যতোটা বাড়বে, অন্ধকার ততোটাই দূর হবে’, যোগ করেন তিনি।
‘জনগণের যেকোনও শ্রেণির উপাসনায় বা উক্ত শ্রেণির ব্যক্তিবর্গ পবিত্র বলিয়া বিবেচিত কোনও বস্তু ধ্বংস, অনিষ্ট বা অপবিত্র করে যে ধর্মীয় অনুভূতি’ তা আপেক্ষিক বলে উল্লেখ করেন শোলাকিয়া ঈদগাহের খতিব ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এটি একেবারেই একটি আপেক্ষিক বিষয়। কার কোন কথায় অনুভূতিতে আঘাত লাগবে সেটা কেউ নির্দিষ্ট করে দিতে পারবে না। ভালবাসা এবং সহনশীলতার অভাবের কারণেই এসব ঘটছে। ধৈর্য্যশক্তি ও সহনশীলতা উভয়ের পক্ষ থেকে দেখালেই কেবল সহিংসতার পথ সমাজ থেকে পরিহার হবে। তবে কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে যেন আঘাত না লাগে, সেদিকে সবারই লক্ষ্য রাখতে হবে। কারণ বাংলাদেশে সব ধর্মের লোকের বাস করে।’
‘ধর্মীয় অনুভূতি সবার সমান। সব ধর্মের মানুষেরই ধর্মীয় অনুভূতি থাকবে এবং সেটা সবার জন্যই প্রযোজ্য’, যোগ করেন তিনি।
অপরদিকে, বার কাউন্সিলের ফাইনান্স কমিটির চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সম্পাদক অ্যাডভোকেট শ. ম. রেজাউল করিম বলেন, ‘কোনওভাবেই ধর্মীয় অনুভুতি সংখ্যাগরিষ্ঠতার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। একজন মানুষ যদি সে সিঙ্গেলও হোন তারও একটি ধর্মীয় অনুভুতি থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম বাংলাদেশে তাদেরই কেবল ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত আসতে পারে, সংখ্যালঘিষ্ঠের ধর্মীয় অনুভূতি নেই, এটা ভাবার অবকাশ নেই। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে— রাষ্ট্রের কাছে ধর্মভিত্তিক কাউকে কোনও বিশেষ গোষ্ঠীকে আলাদা করার সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয় না। সংবিধানে বলা হয়েছে, সব ধর্মের নাগরিকরা সমঅধিকার ভোগ করবে। সেখানে, কোনও নৃ-গোষ্ঠেীর অবহেলিত মানুষটিও যদি হন, তারও সমান ধর্মীয় অনুভূতি রয়েছে এবং তিনিও আইনের চোখে সমান।’
শ. ম. রেজাউল করিম বলেন, ‘আমাদের কেউ যদি শুধু এসে বলেন, আমার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে সেটা প্রমাণের জন্য যথেষ্ঠ নয়। তার ধর্মকে যদি কেউ তাচ্ছিল্য করেন, বিকৃত করেন, ছোট করার মতো আচরণ করেন, যা প্রমাণসাপেক্ষ; কেবলমাত্র সেক্ষেত্রেই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের প্রাথমিক অবস্থা বিবেচনা করা যেতে পারে। উদ্দেশ্যমূলকভাবে কাউকে ছোট করা হয়েছে কিনা সেটাই বিবেচনা করতে হবে। সস্তাদরে কোনও অভিযোগ গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, আইনে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত বলতে কী বোঝায় এর কোনও সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি।’
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না বলেন, ‘‘ধর্মীয় অনুভূতি কোনও সস্তা বিষয় নয় যে কারও কথাতে সেখানে আঘাত লাগবে। আর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত কনসেপ্টটাই ‘ব্যাকওয়ার্ড কনসেপশন’ বলে মনে হয় আমার। একটি গ্রুপই থাকে যারা কনফ্লিক্ট অথবা অরাজকতার জন্য বাহানা খোঁজে। তারা মুসলিম, হিন্দু কিংবা সেক্যুলার সব দেশে গিয়েই একই কাজ করবে, আমাদের দেশেও সেই একই কাজ হচ্ছে, এটা কোনও ইস্যুই না।’’
জেড আই খান পান্না বলেন, ‘জয়পুরহাটে কয়েকদিন আগে পাঁচ থেকে ছয়টি মন্দির ভাঙা হলো, সেটা নিয়ে তো ইস্যু হলো না। আসলে ইসলামসহ কোনও ধর্মই নাজুক নয়।’
তিনি বলেন, ‘আমি তো বলবো প্রথম এই অনুভূতিতে আঘাত করেছেন শফী হুজুর। তিনি নারীদের নিয়ে অশ্লীল কথা প্রথমে বলে কেবল ধর্মীয় নয়, সামাজিক, নৈতিক, মানসিক সব অনুভূতিতে তিনিই প্রথম আঘাত করেছেন। নারী মানেই ভোগের পণ্য এটা ইসলাম বলে না, অথচ তিনি নারীদের নিয়ে চূড়ান্ত রকমের অশালীন মন্তব্য করেছেন-তখন ধর্মীয় অনুভূতি কোথায় থাকে। এইসব অপব্যাখ্যাকারীরাই ইসলামের অনিষ্ট করছেন এবং এরাই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করছে। তারাই আবার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার কথা বলেন।’
‘সবার ধর্মীয় অনুভূতি সমান এবং এখানে কাউকে ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। আর কেউ কিছু বললেই ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত করেছে বলাটা চরম বোকামি, কারণ সেখানে প্রমাণ করে দেখাতে হবে কী করে অনুভূতিতে সে আঘাত করেছে, নয়তো এগুলো হবে ভেক (ভুয়া) অভিযোগ।’
অপরদিকে, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু বলেন, ‘ধর্মীয় অনুভূতি বিষয়টির ব্যাপকতা অত্যন্ত গভীর। কেউ হঠাৎ করে বললেই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হয় না, প্রমাণসাপেক্ষ বিষয় এটি। আর কেবলমাত্র মুসলমান নয়, অন্য যেকোনও ধর্মের মানুষেরই এই অনুভূতি থাকবে এবং প্রতিটি মানুষের অনুভূতি সমান। সুনির্দিষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণসহ বিষয়টি এখানে বিবেচ্য হবে, নয়তো হবে না।’
বাংলা ট্রিবিউন
Discussion about this post