“এমন একটা ঘটনা যা সংঘটিত করলে অপরাধ হবে না, কিন্তু ঘটনা সংঘটনের জন্য প্রচেষ্টা করলে অপরাধ বলে বিবেচিত হবে ? ” ; পেনাল কোড, ১৮৬০ পড়তে গেলেই এই অদ্ভুত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় । আত্মহত্যা সম্পর্কিত অপরাধ একজন সুবিবেচক মানুষের কাছে খটকা লাগবেই , সেটাই স্বাভাবিক। আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকে অপরাধ বলে গন্যকরে ধারা ৩০৯ যা বলে-
“Whoever attempts to commit suicide and does any act towards the commission of such offence, shall be punished with simple imprisonment for a term which may extend to one year, or with fine, or with both.”
অর্থাৎ যদি কোন ব্যক্তি আত্মহত্যার প্রচেষ্টা করেন এবং আত্মহত্যা করা যায়, এমন কিছু করেন ; তিনি সর্বোচ্চ ১ বছরের জেল অথবা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন ।
যেহেতু মৃত ব্যক্তিকে আইনের আওতায় আনা যায় না, তাই আত্মহত্যাকারী সম্পর্কে কোন বিধান রাখা হয়নি ।
যতদূর জানা যায় ব্রিটিশ আমলে রাজবন্দীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় , আত্মহত্যা নিয়ন্ত্রনে আনতে ব্রিটিশরা এই আইনটি তৈরি করে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে গেলে, কেবল মাত্র তখনই অপরাধ বলে বিবেচিত হবে যদি আত্মহত্যার কাজ সম্পাদিত হয় । আত্মহত্যা এবং আত্মহত্যার প্রচেষ্টা এই দুয়ের মধ্যে বিভাজন রয়েছে যা স্পষ্ট করা প্রয়োজন। বরং অনেক ধর্মেই ( বৌদ্ধ, হিন্দু,জৈন ) নির্দিষ্ট পন্থায় দেহত্যাগের বিধান আছে । যা উন্নত বিশ্বে Euthanasia এর মতো স্পর্শকাতর বিষয়কে অনুমোদন দিতে উৎসাহ দিয়েছে এবং দিচ্ছে । ২০ অক্টোবর, ১৯৫৯ সালে ” টাইমস ” পত্রিকা কর্তৃক প্রকাশিত এক সংবাদে দেখা যায় যে, ” Church of England Committee ” আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকে অপরাধের তালিকা থেকে বাদ দিতে সুপারিশ করেছেন । সেই সাথে আত্মহত্যায় প্ররোচনা, সাহায্য, উস্কানিদাতাকে আইনের আওতায় আনার জন্য নতুন ধারা তৈরি করতে অনুরোধ করেছেন । তারও এক বছর আগে ” British Medical Association and the Magistrates’ Association ” ধারাটিকে বাদ দেওয়ার আরজি জানায় । ইংল্যান্ড “The Suicide Act, 1961″ নামে একটি আইন পাসের মধ্যদিয়ে আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকে অপরাধ থেকে বাদ দেয় । এরকম একটা বিতর্কিত আইন এতদিন ধরে থাকায় Dr Simone আক্ষেপ প্রকাশ করে BBC কে বলেন, ” We were one of the last European countries to decriminalise suicide – we were way behind our European counterparts ,We have been very slow and the punitive action that someone’s possessions could be forfeited to the Crown up until 1822 is shocking really.”
আত্মহত্যা নিয়ে কাজ করে এমন আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর অন্যতম হলো ” International Association for Suicide Prevention (IASP) ” ও “World Health Organization (WHO)” যারা যৌথভাবে কাজ করে যাচ্ছে। WHO এর তথ্য মতে ২০১২ সালে সাড়া বিশ্বে ৮৪,০০০০ জন মানুষ আত্মহত্যা করেছে । তারা আরও বলছে যে, সাড়া দুনিয়ায় যুদ্ধ, দ্বন্দ্ব ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে একত্রে যত লোক মারা যায় ; তার চেয়ে আত্মহত্যার সংখ্যা বেশী । প্রতি ৪০ সেকেন্ডে গড়ে এক জন করে মানুষ আত্মহত্যা করছে এবং আত্মহত্যার প্রচেষ্টা করছে অনেকেই যার সংখ্যা ১৫ থেকে ২০ গুণ বেশী । চীন ও ভারতের পরিসংখ্যান অনুযায়ী শুধু মাত্র এশিয়াতেই ৬০% আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে । সাড়া বিশ্বে যে পরিমান আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে তার ২.০৬% বাংলাদেশী । তাদের তথ্যমতে ২০১২ সালে ১,০১৬৭ জন লোক বাংলাদেশে আত্মহত্যা করেছে। তাদের মধ্যে ৫৭৭৩ জন নারী ও ৪৩৯৪ জন পুরুষ । ২০০০ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত পরিসংখ্যানে নারীদের আত্মহত্যার প্রবণতা ৫.৮% বেড়েছে । “The Daily Star” (২৮ এপ্রিল, ২০১২ সাল) পত্রিকা এক প্রতিবেদনে পুলিশ হেডকোয়ার্টার’স এর বরাত দিয়ে বলছে যে , ২০০২ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত; এই ৭ বছরে ৭,৩৩৮৯ জন লোক আত্মহত্যা করেছে। এদের মধ্যে ৩,১৮৫৭ জন গলায় ফাঁস দিয়ে এবং ৪,১৫৩২ জন কীটনাশক ঔষধ পান করে আত্মহত্যা করেছে। এছাড়া ২০১০ সালে শহীদ সোহোরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল আশঙ্কা করে ৬,৫০,০০০০ জন লোক আত্মহত্যার ঝুঁকির মধ্যে আছে। বাংলাদেশে আত্মহত্যার প্রধান কারণগুলো হলো পারিবারিক অশান্তি, দারিদ্র, যৌতুক, কর্মক্ষেত্রে ব্যর্থতা, পরীক্ষায় ফেল করা, প্রেমে ব্যর্থতা ইত্যাদি। আত্মহত্যার কারন অনুসন্ধান করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ডাঃ মোঃ জাহাঙ্গিরুল আলম বলেন যে, আত্মহত্যার প্রধান কারন হতাশা ; ৩০-৭০% আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে হতাশা আর বাইয়োপোলার ডিজঅর্ডার এর কারনে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নয়নের ফলে এটা স্পষ্ট যে, আত্মহত্যার মূলে মানসিক অস্থিরতা ও ভারসম্যহীনতাই দায়ী। আমাদের দেশে সিংহভাগ আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলিতে। মেয়েদের আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশী। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এর তথ্য অনুযায়ী জানুয়ারি ২০০৮ থেকে ডিসেম্বর ২০০৯ সাল পর্যন্ত ৫১১৪ টি ময়নাতদন্ত সম্পাদিত হয়; যার মধ্যে ৯৭০ টি (১৭%) আত্মহত্যা জনিত মৃত্যু। এদের মধ্যে ৬০.১% নারী এবং ৩৯.৯% পুরুষ। ধর্মীয়, আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক তদুপরি আইনগত জটিলতার কারনে সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া প্রায় অসম্ভব। আত্মহত্যার প্রচেষ্টাগুলি সাধারনত ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়। শুধুমাত্র আত্মহত্যা সম্পর্কিত যেটুকু তথ্য পাওয়া যায়; তাতেই বুঝতে বাকি থাকে না এটা কতোটা ভয়াবহ রূপে বিদ্যমান। WHO এর যুক্তি অনুযায়ী আত্মহত্যাকে অপরাধের তালিকা থেকে বাদ দিলে আত্মহত্যা বেড়ে যায় কোন তথ্যে এমন ইঙ্গিত নাই। বরং আত্মহত্যাকে অপরাধ থেকে বাদ দেওয়ায় দেশগুলোতে আত্মহত্যা কমেছে এরূপ দৃষ্টান্ত আছে (শ্রীলঙ্কা)। এতে আত্মহত্যা সম্পর্কিত সঠিক পরিসংখ্যান তৈরি করা সম্ভব হবে । যা আত্মহত্যা কমাতে আমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করবে ।
আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে, পৃথিবীতে যে অল্প কয়েকটি দেশ (বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান,সিঙ্গাপুর,মালয়েশিয়া, চীন ) আত্মহত্যাকে অপরাধ বলে মনে করে ; তাদের অবস্থান এশিয়া মহাদেশ কেন্দ্রিক । এবং এখানে আত্মহত্যার ঘটনা সবচেয়ে বেশী ঘটে। এ থেকে প্রমানিত হয় এই আইনটি অকার্যকর ও অচল। বিকল্প পদ্ধতি অনেক আগেই গ্রহন করা উচিত ছিল। যেমনটি ঘটেছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। দেশটির আইন কমিশন ১৯৭১ সালে ধারা-৩০৯ বাদ দেওয়ার সুপারিশ করে। দুর্ভাগ্যবশত সেটা ঝুলে আছে। ধারাটির শুদ্ধতা নিয়ে বিভিন্ন প্রদেশের হাইকোর্টে বিতর্ক থেমে নাই। খোদ সুপ্রিম কোর্টেই বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে নিম্নোক্ত মামলাগুলি উল্লেখ করা যেতে পারে।
P. Rathinam vs Union of India (AIR 1994 SC 1844)
Gian Kaur v. State of Punjab (AIR 1996 SC 946)
Maruti Shripati Dubal v. State of Maharashtra7, the Bombay High Court
C. A. Thomas Master v. Union of India
State v. Sanjay Kumar Bhatia; Delhi High Court
Chenna Jagadeeswar v. State of Andhra Pradesh ; Andhra Pradesh High Court
Munn v. Illinois , U.S. Supreme Court
Maneka Gandhi v. Union of India
ভারতীয় আদালতের সর্বশেষ অবস্থান ৩০৯ ধারাটি বাতিলের বিরুদ্ধে থাকলেও দেশটির সরকার এই ধারাটি বাতিল করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে ।
উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমাদের পিছিয়ে থাকার কোন কারন নেই । “Penal Code, 1860” এর প্রয়োজনীয় সংশোধন দীর্ঘদিনের দাবী। সেই সাথে “Convention on the Elimination of all forms of Discrimination against Women (CEDAW)” এর দুটি অনুচ্ছেদের (২ এবং ৬.১ অনুচ্ছেদ) উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নারী অধিকারের পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে। এতে নারীদের আত্মহত্যার হার কমবে বলেই বিশ্বাস করি। Anti-Suicide সংগঠন গঠন করে আত্মহত্যাপ্রবণ অসহায় মানুষের পাশে দাড়াতে হবে । জীবন সংগ্রামে বিধ্বস্ত প্রাণগুলিকে সতেজ করে তোলার দায়িত্ব আমার, আপনার , রাষ্ট্রের সকলের। আজ ১০ সেপ্টেম্বর “বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস ” এ না হোক, আগামী বছর এই দিনে কবির সুমনের গানে গলা মিলিয়ে গাইতে চাই-
হাল ছেড়োনা ,
হাল ছেড়োনা বন্ধু, বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোরে ;
দেখা হবে তোমায় আমায়, অন্য গানের ভোরে ।
Discussion about this post