প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে বাংলাদেশের বিচার বিভাগে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আধুনিক প্রযুক্তির জাদুর স্পর্শে বিচারব্যবস্থার ধরনই পাল্টে যাচ্ছে দিন দিন। আদালতে কাজের গতিও বেড়েছে এখন। বাড়ছে মামলা নিষ্পত্তির হার। বয়সে নবীন এবং অতটা প্রবীণ নন এমন অনেক বিচারক ও আইনজীবীই স্মার্টফোনে বেশ অভ্যস্ত। ইদানীং অনেক মামলার রায়ই পাওয়া যায় সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে। এ আদালতে এসেছে অনলাইন কজলিস্টও। ওয়েবসাইটে আগামীকালের কার্যতালিকা দেশ-বিদেশের যে কোনো জায়গা থেকে দেখা যায় ‘আজ’ বিকালেই।
তবে বিচার বিভাগে ডিজিটালাইজেশনের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো সিলেটের ২০টি আদালতে ডিজিটাল এভিডেন্স রেকর্ডিং চালুর ঘটনা। শিগগিরই দেশের ৬৪টি জেলার আদালতেও এ প্রকল্প চালু হচ্ছে। ঢাকার নিম্ন আদালতের কয়েকটি ভবনের বারান্দায় মনিটর বসানো হয়েছে। এতে আদালতগুলোর এজলাসের অবস্থান সম্পর্কে বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীরা জানতে পারেন। আগে এ নিয়ে বেশ বিড়ম্বনায় পড়তেন সংশ্লিষ্টরা। বিচার বিভাগের ডিজিটালাইজেশনের সঙ্গে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অভ্যস্ততা বাড়াতে কিছুদিন আগে ঢাকায় একটি কর্মশালাও শেষ করেছে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন। আর এসবের পেছনে মূল নিয়ামক ও প্রভাবকের ভূমিকা পালন করছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রধান বিচারপতিও স্বপ্ন দেখেন বিচার বিভাগে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগুক। তিনি চান বিচার প্রক্রিয়ায় সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে। সর্বোপরি ডিজিটাল বিচারব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়ায় সময়, শ্রম ও অর্থ সাশ্রয়ের মাধ্যমে বিচারপ্রার্থীদের কষ্ট লাঘব করতে চান তিনি।
এক কর্মশালায় ৪ জুলাই প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, আদালতবান্ধব তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি কাঠামো গড়ে তোলার এখনই সময়। এটি করা হলে একদিকে যেমন স্বল্প সময়ে মামলা নিষ্পত্তি করা যাবে, অন্যদিকে জনগণ তার মামলার অবস্থান সম্পর্কে ঘরে বসেই জানতে পারবে।
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত ‘ডিজিটালাইজেশন অব বাংলাদেশ জুডিশিয়ারি’ শীর্ষক ওই কর্মশালায় তিনি বলেন, ‘দ্রুততম সময়ের মধ্যেই আমরা বিচার বিভাগের ত্রুটি দূর করে ডিজিটাল জুডিশিয়ারির মাধ্যমে বিচারের ক্ষেত্রে দ্রুততা এবং মানুষের জন্য সহায়ক বিচারিক পদ্ধতি দিতে পারব।’
মামলাজট কমাতে বিচার বিভাগে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে প্রধান বিচারপতি বলেন, অল্প খরচে বিচার বিভাগের জন্য উপযোগী তথ্যপ্রযুক্তি কাঠামো তৈরি করতে হবে, যাতে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি সম্ভব হয়।
জানা গেছে, বিচার বিভাগে, বিশেষ করে সুপ্রিমকোর্টে মামলা পরিচালনা, শুনানি ও নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার বিশেষভাবে বেড়েছে। সুপ্রিমকোর্টে কাগজের পাশাপাশি অনলাইনে ডেইলি কজলিস্ট বা কার্যতালিকা প্রকাশিত হচ্ছে। সুপ্রিমকোর্টের উভয় বিভাগের কার্যতালিকা অনলাইনে কাগজের মতো হুবহু ছাপা হচ্ছে।
www.supremecourt.gov.bd ওয়েব ঠিকানায় গেলে সুপ্রিমকোর্টের উভয় বিভাগের কার্যতালিকা, মামলার ফলাফল, কোন আদালতে কোন মামলা বিচারাধীন বা শুনানি হচ্ছে, মামলার বর্তমান অবস্থা, রায় ও আদেশ অনলাইনেই পাওয়া যায়। এ ছাড়া সুপ্রিমকোর্টের বার্ষিক ক্যালেন্ডার, প্রধান বিচারপতিসহ অন্য সব বিচারপতির নামের তালিকা, প্রধান বিচারপতিসহ অন্য সব বিচারপতির সংক্ষিপ্ত বায়োগ্রাফি, সুপ্রিমকোর্টে কর্মরত বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের নামের তালিকা, কেস সার্চ, কজলিস্ট অ্যাপস, বাংলাদেশের বিচার বিভাগের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, বিভিন্ন নোটিস, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি থাকে। ওয়েবসাইটে হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের রুলসও রয়েছে। এ ছাড়া সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের সংবিধান, দেশে প্রচলিত অনেক আইন ও আইন মন্ত্রণালয়ের লিঙ্ক রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বিচার বিভাগের ডিজিটালাইজেশনের ক্ষেত্রে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন প্রধান বিচারপতি। এ লক্ষ্যে সুপ্রিমকোর্টের সহযোগিতায় জাতিসংঘ উন্নয়ন প্রকল্পের (ইউএনডিপি) অর্থায়নে সিলেটের ২০টি আদালতকক্ষে সাক্ষ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে ডিজিটাল এভিডেন্স রেকর্ডিং চালু করা হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, শুনানির সময় ঢাকার নিম্ন আদালতের অনেক আইনজীবীই স্মার্টফোনে মামলার বিষয়বস্তুর প্রমাণ দেখানোর চেষ্টা করেন। তারা মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আসামি বা বাদীর বক্তব্য ধারণ করে আদালতে উপস্থাপন করে থাকেন। অনেক সময় মামলা-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ের স্থিরচিত্র ফোনে ধারণ করে আদালতে নিজেদের পক্ষে উপস্থাপন করে থাকেন তারা। এ বিষয়ে আইনজীবীরা বলেন, ‘বর্তমান যুগ তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। স্মার্টফোনের মাধ্যমে মানুষ এখনই ডিজিটাল বিচারব্যবস্থায় অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। সময়ের সঙ্গে তাল রেখে আমাদেরও এগিয়ে যেতে হবে।’
সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট লায়েকুজ্জামান মোল্লা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমাদের বিচার বিভাগ এগিয়ে যাচ্ছে। দিন দিন ডিজিটালাইজড হচ্ছে। এটি অত্যন্ত সুখকর ও ভালো লাগার বিষয়। বাংলাদেশে ডিজিটালাইজেশনের প্রবক্তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনিই প্রথমে এ বিষয়টি স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই ধারাবাহিকতায় দেশের অন্যান্য সেক্টরের মতো বিচার বিভাগেও প্রযুক্তির জাদুস্পর্শ লেগেছে। আমাদের প্রধান বিচারপতিও মূলত বিচার বিভাগকে ডিজিটালাইজেশনের দিকে এগিয়ে নিচ্ছেন।’
সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, সব সময়, সব জায়গাতেই প্রগতি, উন্নয়ন ও বিজ্ঞানকে সবার গ্রহণ করতে হয়। ডিজিটালাইজেশনের ক্ষেত্রে বিচার বিভাগ অনেক এগিয়ে গেছে। বিষয়টি সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।
এ বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার (প্রশাসন ও বিচার) মো. সাব্বির ফয়েজ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘প্রধান বিচারপতির স্বপ্ন অনুযায়ী বিচার বিভাগে ডিজিটালাইজেশনের যাত্রা ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও দিক -নির্দেশনাতেই আমরা এ বিষয়ে অনেক দূর এগোতে পেরেছি।’ সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন।
Discussion about this post