খাদেমুল ইসলাম
আলোচিত মাজদার হোসেন মামলার রায় ঘোষণার ৮ বছর পর ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ কার্যকর হয়। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় নেওয়া যুগান্তকারী এই পদক্ষেপের পর ৯ বছর অতিবাহিত হয়েছে। এর মধ্যে রায়ে দেওয়া ১২ দফা নির্দেশনার আলোকে কিছু বিষয় বাস্তবায়িত হয়েছে, কিছু বিষয় এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের ৯ বছর পূর্তিতে মাজদার হোসেন মামলার রায়ের মৌলিক অংশের কতটুকু বাস্তবায়ন হলো সেই নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের তৃতীয় পর্ব প্রকাশিত হলো।
প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করতে হলে এর নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি নির্বাহী বিভাগ থেকে মুক্ত করতে হবে। সে জন্যই বিচার বিভাগকে অর্থবহভাবে পৃথক করতে মাজদার হোসেন মামলার রায়ে পৃথক সচিবালয় গঠনের কথা বলা হয়েছিল। সেই রায় অনুযায়ী ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর স্বতন্ত্র জুডিশিয়াল সার্ভিসের যাত্রা শুরু হলেও এই সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণের জন্য ৯ বছরেও আলাদা সচিবালয় গঠনের কোনো উদ্যোগ নেয়নি সরকার।
চার বছর আগে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে সচিবালয় নির্মাণের জন্য ফলক উন্মোচন করেন। এরপর সচিবালয়ের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের দিনক্ষণ নির্ধারণের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দেন তিনি। তবে সেই বিষয়ে আপাতত কোনো অগ্রগতি নেই বলে সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠায় সুপ্রিম কোর্ট আইন মন্ত্রণালয়কে বারবার তাগিদ দিলেও সচিবালয় গঠনের ক্ষমতা মন্ত্রণালয়ের নাই বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘‘বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচারবিভাগীয় দায়িত্বপালনে রত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল-নির্ধারণ, পদোন্নতিদান ও ছুটি মঞ্জুরীসহ) ও শৃঙ্খলাবিধান রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত থাকিবে এবং সুপ্রিম কোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তাহা প্রযুক্ত হইবে।’’
তাই বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি সবই করার একক এখতিয়ার সুপ্রিম কোর্টের। তবে প্রয়োজনীয় জনবল ও অবকাঠামো না থাকায় এখন ‘উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ’ সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শে এসব কাজ করে থাকে।
জুডিশিয়াল সার্ভিসের জন্য ২০০৭ সালে করা এ সংক্রান্ত বিধি অনুযায়ী উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের সংজ্ঞায় সংশ্লিষ্ট (আইন) মন্ত্রণালয়কে রাখা হয়েছে। উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ হিসেবে বিচার বিভাগীয় সচিবালয় গঠন করা হলে সুপ্রিম কোর্ট স্বাধীনভাবে বিচার প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
তাছাড়া সরকার প্রতি অর্থবছর এই সচিবালয়ের খরচের জন্য, এর অনুকূলে বাজেটে নির্দিষ্টকৃত অর্থ বরাদ্দ করবে এবং অনুমোদিত ও নির্ধারিতখাতে ওই বরাদ্দকৃত অর্থ থেকে খরচ করার ক্ষেত্রে সরকারের পূর্বানুমোদন গ্রহণ করা জুডিশিয়াল সার্ভিস সচিবালয়ের জন্য আবশ্যক হবে না। যার মাধ্যমে বিচার প্রশাসন আর্থিকভাবেও সম্পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করবে।
বিচার বিভাগীয় সচিবালয় গঠন করা হলে পুরো বিচার বিভাগের কাজে গতিশীলতা আসবে বলে মনে করেন মাজদার হোসেন মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম। তিনি বলেন, এখন হাইকোর্ট বিভাগের নিয়ন্ত্রণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব প্রধান বিচারপতির উপর পড়ে, এতে আপিল বিভাগের আইনের ব্যাখ্যার মতো মূল ভূমিকা নির্লিপ্তভাবে পালন করতে সমস্যা হয়। সেক্ষেত্রে হাইকোর্ট বিভাগের অধীনে সচিবালয় হলে আপিল বিভাগ সেসব কাজ করতে পারতো।
সচিবালয় গঠনের বিষয়ে জানতে চাইলে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলতে চাননি হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী। তবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এখনো অনেকটা পথ যে বাকি আছে সেটি উল্লেখ করেন তিনি। সাবেক এই বিচারপতি গণমাধ্যমকে বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য আরও অনেক দুর্গম পথ অতিক্রম করতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো কে হবেন এই দুর্গম অভিযাত্রী দলের কাণ্ডারি?
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, সারাদেশের নিম্নআদালতগুলোর বিচারকদের কার্যক্রম, মামলা-মোকাদ্দমা সংক্রান্ত খোঁজখবর রাখার জন্য সুপ্রিম কোর্টের পক্ষে কাজ করতে একটি পৃথক সচিবালয় গঠনের কথা বলা হয়েছে। সেই সচিবালয়ের যারা কর্মকর্তা-কর্মচারি থাকবে, তারা সুপ্রিম কোর্টকে এসব বিষয় জ্ঞাত করবেন। যাতে সুপ্রিম কোর্ট সঠিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু তা না হওয়ার কারণে এখনো আমাদের নিম্নআদালতের বিচারকদের বদলি, অসদাচারণের ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের ওপর আমাদের নির্ভরশীল থাকতে হয়।
বিচার বিভাগীয় সচিবালয় গঠনের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের ডেপুটি রেজিস্ট্রার সাব্বির ফয়েজ গণমাধ্যমকে বলেন, সচিবালয় গঠন প্রসঙ্গে অগ্রগতির বিষয়ে কোনো কিছু আমার জানা নেই।
সচিবালয় না হওয়ায় এখন আইন মন্ত্রণালয় সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ অনুযায়ী বিচার প্রশাসনের শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এমনকি এ সংক্রান্ত বিধিতে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বিধিতে আরও রয়েছে, মন্ত্রণালয় ও সুপ্রিম কোর্টের মধ্যে কোনো বিষয়ে মতানৈক্য হলে সুপ্রিম কোর্টের মতামত প্রাধান্য পাবে।
তা সত্ত্বেও কার্যত সুপ্রিম কোর্টের সব পরামর্শও বাস্তবায়ন করা হয় না। সুপ্রিম কোর্ট যেসব পরামর্শ দেয় তার কতটুকু বাস্তবায়ন হয়, জানতে চাইলে সাব্বির ফয়েজ বলেন, ‘কিছু হয়, কিছু হয় না। তবে ঠিক কতটুকু বাস্তবায়ন হয়, তা পুরো পরিসংখ্যান না দেখলে বলা যাবে না।’ পৃথক সচিবালয় থাকলে এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে।
সচিবালয় গঠন নিয়ে সুপ্রিম কোর্টও যে তৎপর তার প্রমাণও মিলেছে বিভিন্ন সময়ে। সম্প্রতি হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, অনেক সময় শোনা যায়, স্বাধীন হয়ে গেছি আমরা। এই দিকে সেক্রেটারিয়েট নাই। প্রধান বিচারপতি বার বার বলেন, আমাদেরকে সেক্রেটারিয়েট দাও। মিনিস্ট্রি পাত্তাই দেয় না। মিনিস্ট্রি পাত্তা দিবে কেন? মিনিস্ট্রি হল সরকারের। আমরা হলাম জুডিশিয়ারি, এই জুডিশিয়ারির কথা শুনবে কে?
বিচারপতির এই বক্তব্যের সঙ্গে আইন মন্ত্রী অবশ্য একমত নন। বরং সচিবালয় গঠনের ক্ষমতাই আইন মন্ত্রণালয়ের নাই বলেও উল্লেখ করেন তিনি। সম্প্রতি নরসিংদীতে এক অনুষ্ঠানে মন্ত্রী বলেন, আইন মন্ত্রণালয়ের বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করার কোন ক্ষমতা নেই। রুলস অব বিজনেস, অ্যালোকেশন অব বিজনেস ও সংবিধান পড়লে দেখা যাবে আইন মন্ত্রণালয় কোন সচিবালয় প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম করে দিতে পারে না। সূত্র: দ্য রিপোর্ট
Discussion about this post