উচ্চ মুনাফা আর মালিকানা- প্রলোভনের এই দুই ‘মুলা’ ঝুলিয়ে নিয়ম ভেঙে কর্মীদের কাছ থেকে দেড় কোটি টাকার বেশি অর্থ সংগ্রহের অভিযোগ উঠেছে ‘দক্ষ হ্যাকার তৈরি’র বিজ্ঞাপন দেওয়া সাইফুর’স কোচিং সেন্টারের বিরুদ্ধে।
মুনাফা আর মালিকানা দূরের কথা, লগ্নি করা আসল টাকা ফেরত পাওয়া নিয়েই এখন অনিশ্চয়তায় বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
কর্তৃপক্ষের কৌশল আর চাপে পড়ে ধার-দেনা বা স্ত্রীর গহনা বিক্রি করে টাকা দিয়ে এখন পথে বসার উপক্রম অনেকের। টাকা চাইলেই চাকরিচ্যুত বা কর্তৃপক্ষের বিরাগভাজন হতে হবে- এমন আশঙ্কায় মুখ বুজেই অনিয়ম সহ্য করছেন সাইফুর’স-এর কর্মীরা।
নিয়মিত বেতন ভাতা না পেয়ে চাকরিও ছেড়েছেন কেউ কেউ। লগ্নি করা টাকা ফেরত পেতে আইনের আশ্রয় নেওয়ার উপায় খুঁজছেন অনেকে। বাংলানিউজের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে মুনাফা দেওয়ার নামে প্রতারণার এসব চিত্র।
এই অনিয়ম আর প্রতারণার সব অভিযোগের তীরে বিদ্ধ সাইফুর’স কোচিং সেন্টারের মালিক তথা সাইফুরস প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুর রহমান খান ওরফে নিপু।
প্রথমে ব্র্যাক ব্যাংক থেকে ‘সাইফুর’স কোচিং’-এর নামে ঋণ নিয়ে তা বিনিয়োগ করা হয় পাঠশালা পাবলিকেশন্স নামে একটি প্রতিষ্ঠানে। বছরে কোটি-কোটি টাকা লাভ। শেয়ারের সঙ্গে রয়েছে উচ্চ লভাংশ। এমন সব প্রলোভন দেখিয়ে যুবক কর্মীদের কাছে থেকে নেওয়া হয় দেড় কোটি টাকা। মালিকের আস্থাভাজন হতে কেউবা চাকরির নিরাপত্তায় ধার-দেনা বা স্ত্রীর গহনা বিক্রি করে টাকা তুলে দেন সাইফুর রহমান খান নিপুর হাতে।
সূত্র মতে, বছর চারেক আগে সাইফুর রহমান খান নিপু ফেঁসে যান প্রেমের জালে। প্রথম স্ত্রীর অমতে ধর্মের লেবাসধারী নিপু বিয়ে করেন সিরাজগঞ্জের মেয়ে শামসা আর খান ডলিকে। এটি ডলির তৃতীয় আর নিপুর দ্বিতীয় বিয়ে।
আগে স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তিই ছিলো প্রথম স্ত্রীর নামে। অমতে দ্বিতীয় বিয়ের পর পরই নিপুর দূরত্ব সৃষ্টি হয় প্রথম স্ত্রী মোর্শেদা জামান খানের সঙ্গে।
সেই সুযোগে সাইফুর’স প্রাইভেট লিমিটেডের চেয়ারপারসনের পদ বাগিয়ে নেন দ্বিতীয় স্ত্রী ডলি। প্রথম স্ত্রীর ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, ডলির অযাচিত খবরদারি, যত্রতত্র হস্তক্ষেপ এবং অব্যবস্থাপনা আর পারিবারিক বিরোধে বেসামাল হয়ে পড়েন নিপু।
সেই সঙ্গে অদক্ষ ব্যবস্থাপনা ও দ্বিতীয় স্ত্রীর খবরদারিতে পাঠশালা পাবলিকেশন্স জন্মের পর পরই পরিণত হয় লোকসানি প্রতিষ্ঠানে। এদিকে, ব্যাংক ব্যবস্থাপনা থেকে অর্থের টান পড়লে দ্বিতীয় স্ত্রীর পরামর্শে মোটা অঙ্কের মুনাফা ও মালিকানা দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে অর্থ সংগ্রহ করা হয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে।
জনসাধারণের কাছ থেকে আমানত বা অর্থ সংগ্রহের নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে অনেকটা জোর জবরদস্তি করে কর্মীদের কাছ থেকে দেড় কোটির বেশি টাকা সংগ্রহ করেন নিপু।
সূত্র মতে, ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন নানা কৌশলে টাকা উঠিয়ে নিলেও ৫৮ জনের ৭৩ লাখ ২৪ হাজার টাকা এখনও লাভ ছাড়াই দেনার খাতায় লেখা রয়েছে নিপুর নামে।
এদিকে, হ্যাকার তৈরির নামে ‘চোর বানানোর বিজ্ঞাপন’ দেওয়া প্রতিষ্ঠানটি আস্থার সংকটে পড়ায় কর্মীদের বেতন-ভাতা দেওয়াও হয়ে পড়ে অনিয়মিত।
পিয়ন ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা ঈদের আগে-পরে ভেঙে-ভেঙে পেয়েছেন গত মাসের বেতনের টাকা। তবে কর্মকর্তা ও শিক্ষকরা এখনও পাননি বেতনের পুরো টাকা।
সাইফুর’স-এর নামে ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়ে অন্যত্র বিনিয়োগ, হ্যাকার তৈরির নামে চোর বানানোর বিজ্ঞাপনে আস্থার সংকট, ব্যবসায় মন্দা, পরিস্থিতি সামলাতে নানা খাতে অর্থ ঢালা, নতুন বিনিয়োগে রুগ্নতা, দুই স্ত্রীকে নিয়ে পারিবারিক দ্বন্দ্ব- সব মিলিয়ে ব্যক্তি ছাড়াও সাইফুর’স-এর বিনিয়োগকারী ব্যাংক ছাড়াও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কপালে পড়ে উদ্বেগের ভাঁজ।
সূত্র জানায়, ব্র্যাক ব্যাংক, লংকাবাংলা ফিন্যান্সসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সাইফুর’স-এ বিনিয়োগ করে এখন ফেঁসে গেছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ঝুঁকির মাত্রা বেড়ে গেছে এসব বিনিয়োগের। কারণ, সময়মতো ঋণের কিস্তি দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
একদিকে, ২৬টি নিজস্ব কোচিং সেন্টারের কর্মীদের সময়মতো বেতন পরিশোধে ব্যর্থতা; অন্যদিকে ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপ, তার ওপর কর্মীদের মুনাফার নামে লগ্নি করা অর্থ ফেরতের আবদার- সব মিলিয়ে মারাত্মক আর্থিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
যে কারণে শিক্ষার্থী টানতে শিক্ষকদের কমিশনের নামে ঘুষসহ নানা অনিয়ম আর অনৈতিক কাজে বাধ্য করা হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির কর্মীদের।
যোগাযোগ করা হলে নিপুর দ্বিতীয় স্ত্রী ও সাইফুর’স প্রাইভেট লিমিটেডের চেয়ারপারসন শামসা আর খান ডলি আর্থিক সংকটের বিষয়টি স্বীকার করে বাংলানিউজকে জানান, হ্যাকার তৈরির বিজ্ঞাপন দেওয়ার পর থেকে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে।
তবে কর্মীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি তিনি।
এখন পর্যন্ত ৫৮ জন কর্মীর লগ্নি করা প্রায় কোটি টাকা ফেরত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বলে সূত্রের দাবি।
মালিকানা ও মুনাফার টোপ ফেলে ১০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে লক্ষাধিক টাকা কর্মীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে সাইফুর’স। ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নেওয়ার তথ্য পাওয়া যায়।
এর মধ্যে উত্তরা শাখার শিক্ষক লতিফ টিপুর কাছ থেকে শেয়ার দেওয়ার অনুপাতে দুই লাখ ১৫ হাজার, সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এটিএম মাহমুদের কাছ থেকে সাড়ে তিন লাখ, ঢাকার কামরুন্নেছার কাছ থেকে চার লাখ টাকা, গাড়ি চালক জসিম খানের কাছ থেকে ৫৪ হাজার টাকা, প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) মাহমুদুল আলমের কাছে থেকে আড়াই লাখ টাকা, ডিজাইনার আব্দুর রহিমের কাছ থেকে এক লাখ টাকা, মার্কেটিংয়ের নোমানের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা, বই বিক্রেতা শফিকুল ইসলামের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা, সাভার শাখার ইনচার্জ মির্জা আমিন আহমেদের কাছ থেকে ১২ লাখ টাকা- এভাবে দেড় কোটির বেশি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সাইফুর’স।
বিভাগীয় জেলা শহরের একজন শাখা ইনচার্জ জানান, কী করবো, চাকরি করি। বস বললেন, টাকা বিনিয়োগ করতে। স্ত্রীর গহনা বিক্রি করে বিনিয়োগ করলাম। লাভের কোনো খবর নেই। টাকা ফেরত চেয়ে এখন উল্টো রোষানলে পড়েছি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কর্মরত আরেকজন বিনিয়োগকারী জানান, যে প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে বিনিয়োগে বাধ্য করা হয়েছিলো সেটি এখন লোকসানে রুগ্ন। বলতে গেলে মুখ থুবড়ে পড়েছে। জানি না টাকাগুলো আদৌ ফেরত পাবো কিনা। তারা বলছেন, মালিকানায় লাভ হলে লাভ, লস হলে লস।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, একটি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ভিত্তি কতোটা দুর্বল হলে তারা গাড়ি চালকদের কাছে মালিকানা দেওয়ার বদলে মাত্র ১০ হাজার টাকা নিতে পারে। তারা কতোইবা বেতন পান।
এসব নিছক কর্মচারী থেকে মালিক বানানোর স্বপ্ন দেখানোর নামে প্রতারণা বলেও জানান তিনি।
সাইফুর’সয়ে চার লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ করেছেন। এমন একজন জানান, এতোদিন সঞ্চয়পত্র কিনলেও টাকাটা যেমন নিরাপদ থাকতো তেমনি মুনাফাও পেতাম।
‘মাথায় টুপি। দাঁড়িশোভিত চেহারা। জোব্বাধারী সাইফুর রহমান নিপু স্যারের কথায় আকৃষ্ট হয়ে বিনিয়োগ করেছিলাম। ভেবেছিলাম, বেতনের বাইরে মালিকানার সঙ্গে কিছু মুনাফাও আসবে। কিছুই আসেনি। এসেছে পারিবারিক অশান্তি।’
বোকামির দণ্ডের জন্য এখন সকাল-বিকেল বউয়ের তর্জন গর্জন শুনতে হয়! কেনই বা আমাদের সঙ্গে এই প্রতারণা। এটাই বা হ্যাকিংয়ের চাইতে কম কী! তাহলে কি সাইফুর রহমান নিপুর জোব্বার আড়ালে এই মতলবই ছিলো! সঞ্চয়ের সব অর্থ তুলে দিয়ে এমন আক্ষেপ তার।সুত্র বাংলানিউজ
Discussion about this post