প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং রায়ের পর্যবেক্ষণ বিশদভাবে পর্যালোচনার নির্দেশ দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল রোববার সকালে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে গেলে এই নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।
সরকারের একাধিক আইন কর্মকর্তা এবং আওয়ামী লীগের কয়েকজন নীতিনির্ধারক নেতা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর এমন নির্দেশের পর সর্বোচ্চ আদালতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় দ্রুত পুনর্বিবেচনার আবেদন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া রায়ের পর্যবেক্ষণে যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রত্যাশিত ও অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে, তা বাতিল করার বিষয়টি রিভিউ আবেদনে থাকবে। আগস্ট কিংবা সেপ্টেম্বরের মধ্যে রিভিউ আবেদনের প্রস্তুতি রয়েছে। কোনো কোনো সূত্র অবশ্য আগামী দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে রিভিউ আবেদন করা হতে পারে বলে জানিয়েছে। এর আগে আগামী বছরের জানুয়ারিতে রিভিউ আবেদন করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
গত শনিবার রাতে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সঙ্গে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সাক্ষাতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদের গতকাল শেখ রাসেল রোলার স্কেটিং কমপ্লেক্সে ক্রীড়া পরিবারের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামালের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এক আলোচনায় বলেছেন, তিনি শনিবার প্রধান বিচারপতির ফুলার রোডের সরকারি বাসভবনে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় ও রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে সরকার এবং আওয়ামী লীগের বক্তব্য তুলে ধরেছেন। ওবায়দুল কাদের আরও বলেছেন, এ নিয়ে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আরও আলোচনা হবে। এর বাইরে তিনি আর কোনো মন্তব্য করেননি।
প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সেতুমন্ত্রীর সোয়া দুই ঘণ্টার ওই সাক্ষাতের পর গতকাল এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানা আলোচনা চলে। অনেকেই এ নিয়ে ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গেও কথা বলেছেন। দলের নীতিনির্ধারক নেতারাও গতকাল সন্ধ্যার পর প্রধানমন্ত্রীর ধানমণ্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে এ নিয়ে সেতুমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে বিশদ জানতে চান।
জানা গেছে, সাক্ষাতের সময়ে প্রধান বিচারপতি ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছাড়া আর কেউই উপস্থিত ছিলেন না। সাক্ষাতের পর তারা নৈশভোজেও অংশ নেন। প্রধান বিচারপতির বাসভবনে যাওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন ওবায়দুল কাদের। পরে তিনি গতকাল সকালে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে তার সাক্ষাতের বিষয়বস্তু তাকে অবহিত করেন।
সাক্ষাতের সময় সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রধান বিচারপতি ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বিশদ আলোচনা করেছেন বলে জানা গেছে। রায়ের পর্যবেক্ষণে আপত্তিকর অংশগুলো প্রত্যাহারের বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। দীর্ঘ রায়ের কিছু অংশ নিয়ে একটি মহল সুযোগ নিতে পারে বলেও প্রধান বিচারপতিকে অবহিত করা হয়েছে। সাক্ষাৎকালে রায়কে কেন্দ্র করে বিচার বিভাগের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগের মধ্যে সৃষ্ট দূরত্ব কমিয়ে আনার বিষয়টিও গুরুত্ব পেয়েছে।
ওবায়দুল কাদেরের আগে আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু, উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করেছেন। এ ছাড়া প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস এমপি।
এদিকে, রায়ের অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য এক্সপাঞ্জ চেয়ে আবেদন কিংবা রিভিউ কবে নাগাদ করা হতে পারে- এমন প্রশ্নে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘৭৯৯ পৃষ্ঠার দীর্ঘ রায় পড়ে জায়গাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। আজ-কাল-পরশুর মধ্যে হয়ে যাবে- সেটা আমি বলব না। রায়ে আপত্তিকর, অপ্রীতিকর ও অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা আছে। সেগুলো এক্সপাঞ্জ করার কথা বলা হয়েছে। এ বিষয়ে কাজ চলছে। এক্সপাঞ্জ করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের বিধান অনুযায়ী রিভিউ আবেদন করার প্রয়োজন হলে তা-ই করা হবে।
রাষ্ট্রের শীর্ষ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, রিভিউ কিংবা শুধু অপ্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো রায় থেকে বাদ দেওয়ার জন্য আপিল বিভাগে আবেদন করতে কোনো নির্দেশনা এখনও সরকার থেকে আসেনি। মাহবুবে আলম বলেছেন, রায় পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে।
আইন অনুযায়ী, পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের ৩০ দিনের মধ্যে রিভিউ আবেদন করতে হবে। তবে বিলম্বের জন্য মার্জনা চেয়ে যে কোনো সময় রিভিউ করার সুযোগ রয়েছে। অতীতে এমন উদাহরণ রয়েছে।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির বেঞ্চ সর্বসম্মতভাবে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করেন। প্রধান বিচারপতি নিজেই মূল রায়টি লিখেছেন। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের বিষয়ে সব বিচারপতি একমত হলেও বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ছাড়া অন্য পাঁচ বিচারপতি এ বিষয়ে নিজেদের অভিমত দিয়েছেন।
রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি, সুশাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচনা করেছেন। পর্যালোচনায় তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্য করেছেন। তার এ মন্তব্য নিয়ে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন মহলে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। মন্ত্রিসভায় অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে। সিনিয়র মন্ত্রীরা রায় ও রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করছেন। আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হকও সমালোচনার পাশাপাশি রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতির বক্তব্যকে অগ্রহণযোগ্য হিসেবে অভিহিত করে তা এক্সপাঞ্জ করার উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলেছেন। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ রায়ে প্রধান বিচারপতির অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য ও পর্যবেক্ষণের প্রতিবাদে তিন দিনের কর্মসূচি পালন করছে।
আওয়ামী লীগ নেতারা জানিয়েছেন, সর্বোচ্চ আদালতে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হওয়ায় তারা ক্ষুব্ধ। জাতীয় সংসদ হলো আইনসভা। সবার উর্ধ্বে সংসদের স্থান। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সংবিধানে এই অধিকার সংসদকে দেওয়া হয়েছে। অথচ ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণের পর পরিস্থিতি ভিন্ন রূপ নিয়েছে। দলের নেতা-কর্মীরা রায়ের পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত হতে পারছেন না। তাদের দৃষ্টিতে, রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রয়োজনের বাইরে অনেক কিছু বলা হয়েছে। তারপরও বিচার বিভাগের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করতে চাইছে না সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের চেষ্টা রয়েছে। তারা খুব সতর্কভাবেই বিরাজমান পরিস্থিতি সামাল দিতে চাইছে। এ অবস্থায় সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জাতীয় সংসদে আরেক দফা আলোচনার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। আগামী সেপ্টেম্বর মাসে সংসদের অধিবেশন বসবে।
-সমকাল
Discussion about this post