২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার আগে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দুই দফা হত্যার চেষ্টা করা হয়। এর মধ্যে প্রথম হত্যাচেষ্টা হয় ২৭ বছর আগে ঢাকার ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে হামলা চালিয়ে। আর দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে ১৬ বছর আগে, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনার জনসভার মঞ্চের কাছে বোমা পেতে রেখে। দুটি ঘটনায় মামলা হয়েছে চারটি, যার কোনোটিরই এখন পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়নি।
এই দীর্ঘ সময়ে আওয়ামী লীগ তিন দফায় ক্ষমতায় এলেও ঠিকভাবে আদালতে সাক্ষী হাজির করতে না পারায় মামলাগুলোর বিচার ঝুলে আছে। এর মধ্যে প্রথম ঘটনায় ফ্রিডম পার্টি ও দ্বিতীয়টিতে হরকাতুল জিহাদের (হুজি-বি) জঙ্গিদের দায়ী করে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। অবশ্য সর্বশেষ ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে আওয়ামী লীগের ২২ নেতা-কর্মীকে হত্যা এবং তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় করা মামলা দুটির বিচারকাজ চলছে।
আদালত-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার পুরোনো চারটি মামলা যেসব সাক্ষীর কারণে ঝুলে আছে, তাঁদের মধ্যে সাক্ষী রয়েছেন পুলিশের সদস্যও। এসব সাক্ষীর অনেকে অবসরে চলে যাওয়ায় তাঁদের আর পাওয়া যাচ্ছে না।
মামলা চারটি চলছে ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত এবং দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে। এসব আদালতের সরকারি কৌঁসুলিরা বলছেন, দফায়-দফায় আদালত থেকে সাক্ষীদের প্রতি সমন এবং জামিন-অযোগ্য পরোয়ানা জারি করেও কাজ হয়নি। এ অবস্থায় মামলাগুলোর বিচারকাজ কবে নাগাদ শেষ হবে, তা অনিশ্চিত।
প্রথম হত্যাচেষ্টা: এরশাদ সরকারের আমলে ১৯৮৯ সালের ১০ আগস্ট মধ্যরাতে ঢাকার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বঙ্গবন্ধু ভবনে হামলা করে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। এ ঘটনায় বাড়ির নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্য মো. জহিরুল ইসলাম ধানমন্ডি থানায় মামলা করেন। তাতে বলা হয়, ফ্রিডম পার্টির সদস্য কাজল ও কবিরের নেতৃত্বে ১০-১২ জনের একটি দল ৩২ নম্বরের বাড়িতে অতর্কিতে গুলিবর্ষণ ও বোমা হামলা করে। হামলাকারীরা তখন ‘কর্নেল ফারুক-রশিদ জিন্দাবাদ’ বলে স্লোগান দেয়।
নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মামলাটির তদন্ত গতি পায়। এরপর ১৯৯৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সিআইডি তদন্ত শেষ করে অভিযোগপত্র দেয়। ফ্রিডম পার্টির নেতা ও বঙ্গবন্ধুর খুনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) আবদুর রশিদ, মেজর (অব.) বজলুল হুদাসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। এরপর আওয়ামী লীগ সরকারের বাকি মেয়াদে এবং পরে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের সময় মামলার কার্যক্রম আর এগোয়নি।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ৫ জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন ও বিচারকাজ শুরু হয়। ওই বছরের ২৭ আগস্ট মামলার বাদী পুলিশের হাবিলদার জহিরুল হক সাক্ষ্য দেন। তখন তিনি বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশে কর্মরত। ২০১৩ সালের ২ মে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির খালেকুজ্জামান সাক্ষ্য দেন। পুনরায় তাঁকে সাক্ষী হিসেবে ডাকা হলে ২০১৪ সালের ২৬ ডিসেম্বরে তিনি সাক্ষ্য দেন।
এ-সংক্রান্ত মামলা দুটি ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন। এই আদালতের রাষ্ট্রপক্ষে কৌঁসুলি বশীর আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, বিদেশে পলাতক একজন আসামি নাজমুল মাকসুদকে (মুরাদ) ২০১৪ সালের মার্চে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। এ কারণে মামলার বাদী হাবিলদার জহিরুল হক ও তদন্তকারী কর্মকর্তা খালেকুজ্জামানকে আবারও তলব করা হয়। কিন্তু তাঁরা সাক্ষ্য দিতে আসছেন না।
আসামিদের মধ্যে পাঁচজন এখন কারাগারে। তাঁরা হলেন গোলাম সারোয়ার, ফ্রিডম সোহেল, জর্জ, মো. শাহজাহান (বালু) ও নাজমুল মাকসুদ। জামিনে আছেন হুমায়ুন কবির, মিজানুর রহমান, খন্দকার আমিরুল ইসলাম (কাজল) ও গাজী ইমাম হোসেন। পলাতক আছেন লে. কর্নেল (অব.) আবদুর রশিদ, মো. হুমায়ুন কবির, জাফর আহম্মদ ও রেজাউল ইসলাম খান। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় সৈয়দ ফারুক রহমান ও বজলুল হুদার ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হওয়ায় তাঁদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
দ্বিতীয় দফা হত্যাচেষ্টা: ২০০০ সালের ২২ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভা ছিল। এর কাছাকাছি স্থানে ৭৬ কেজি ওজনের একটি বোমা মাটিতে পুঁতে রাখা হয়েছিল। জনসভার দুদিন আগে পুঁতে রাখা বোমা উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় হত্যাচেষ্টা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দুটি মামলা করে কোটালীপাড়া থানার পুলিশ।
তদন্তে বেরিয়ে আসে, শেখ হাসিনাকে হত্যার লক্ষ্যে জঙ্গি সংগঠন হুজি-বি এই বোমা পেতে রেখেছিল। ২০০১ সালের ৮ এপ্রিল হুজি-বি নেতা মুফতি আবদুল হান্নানসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। পরে অধিকতর তদন্ত শেষে ২০০৯ সালের ২৯ জুন নতুন করে আরও নয়জনকে আসামি করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। এ নিয়ে মোট আসামি ২৫ জনের মধ্যে মুফতি হান্নানসহ ১১ জন কারাগারে রয়েছেন। একজন জামিনে এবং বাকি ১৩ জন পলাতক।
মামলা দুটির বিচারকাজ প্রথমে গোপালগঞ্জের আদালতে শুরু হয়। পরে ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তরিত হয়। বর্তমানে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২-এ বিচারাধীন। এরপর ২০১২ সালের ১ আগস্ট আসামি মুফতি হান্নানের খালাতো ভাই বদিউজ্জামান সাক্ষ্য দেন।
ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের বিশেষ কৌঁসুলি সৈয়দ সামসুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, সাক্ষী না আসায় বিচারকাজ আটকে আছে। নয় পুলিশ কর্মকর্তাসহ ১৯ জন সাক্ষীর প্রতি দফায়-দফায় সমন ও জামিন-অযোগ্য পরোয়ানা জারি করা সত্ত্বেও তাঁরা সাক্ষ্য দিতে আসেননি। এ ছাড়া গোপালগঞ্জের আদালতে বিচারকালে রাষ্ট্রপক্ষে ৮৯ জন সাক্ষীর মধ্যে ৪১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছিল। এরপর কোনো কারণ উল্লেখ না করেই রাষ্ট্রপক্ষ ৪১ সাক্ষীকে পুনরায় তলবের আবেদন করে এবং গোপালগঞ্জের আদালত তা মঞ্জুর করেন। এখন ওই ৪১ জন সাক্ষীকেও হাজির করা যাচ্ছে না।
সাক্ষী হাজিরের দায়িত্ব আদালত পুলিশের অপরাধ তথ্য ও প্রসিকিউশন বিভাগের। এই চার মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকার অপরাধ তথ্য ও প্রসিকিউশন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত উপকমিশনার আমিনুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, পুলিশ সাক্ষী হাজির করতে পারছে না, এটা ঠিক না। রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিদের অবহেলার কারণে মামলাগুলোর বিচার বিলম্ব হচ্ছে। আগে সাক্ষ্য দিয়েছেন এমন সাক্ষীকে আবার নতুন করে ডাকা হয়েছে। পুলিশ সদস্য সাক্ষীদের অনেকে অবসরে চলে গেছেন।
ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও ফৌজদারি আইনজ্ঞ কাজী নজিবুল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেন, এ দুটি ঘটনায় করা মামলা চারটি গুরুত্বপূর্ণ। এসব মামলা এত দিনেও শেষ করতে না পারার ব্যর্থতা রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি ও পুলিশ প্রসিকিউশনের। সূত্র: প্রথম আলো।
Discussion about this post